ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল, যেখানে ভোগান্তির শেষ নেই
ভূমি জরিপ সংক্রান্ত বিভিন্ন দলিলাদি সংশোধনীর জন্য গঠিত দেশের ৪৪টি ভূমি জরিপ বা ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে রয়েছে মামলার তীব্র জট।
আইন অনুযায়ী, মামলা দায়েরের এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর অতিক্রম হয়ে গেলেও এসব মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
বিভিন্ন জেলার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বিচার শেষে মামলার রায় ঘোষণার পর তার বিরুদ্ধে করা আপিল নিষ্পত্তির জন্য আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে। ২০১৯ সালে ৯০ দিনের মধ্যে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনে হাইকোর্র্টের নির্দেশনা থাকলে তার বাস্তবায়ন নেই।
ফলে, একদিকে বিচারিক আদালতে ভোগান্তিতে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরা। অন্যদিকে, রায় হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আপিল করতে আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় হাইকোর্র্টে রিট করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে ভোগান্তির যেন শেষ নেই।
সুপ্রিম কোর্টের পরিসখ্যান অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন লাখ মামলার বিচার ঝুলে ছিলো। এসব মামলার মধ্যে প্রায় এক লাখ ১৬ হাজার মামলা পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন।
বিচারিক আদালতে রায় হওয়া প্রায় দেড় লাখ মামলার রায়ের বিরুদ্ধে রিট নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছেন হাইকোর্র্ট।
এ সংক্রান্ত হাইকোর্টে দায়ের হওয়ার রিটের রায়ের বিরুদ্ধে প্রায় ১১ হাজার আপিল ঝুলে আছে সুপ্রিম কোর্র্টের আপিল বিভাগে।
কী হয় এই ট্রাইব্যুনালে?
আইন মন্ত্রণালয়ের সুত্রে জানা যায়, ২০০৪ সালে রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ সংশোধন করে জরিপ সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় সংশোধনীর সুযোগ দিয়ে আইনে নতুন বিধান যোগ করা হয়। আইন সংশোধনের পর ৩২টি ও ২০১২ সালে আরও ১২টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় বিভিন্ন জেলায়।
বিএসআর (বাংলাদেশ রিভাইজ রেকর্ড অব রাইটস) জরিপের ভুল সংশোধন করতে ভূমি মালিকদের যেতে হয় ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালে। ট্রাইব্যুনাল ভূমির মালিকানা সংক্রান্ত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত মালিকদের মালিকানা ফিরিয়ে দেন।
২০০৪ সালে আইনটির সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়ার প্রস্তাবে বলা হয়, দেশে বিএসআর জরিপ শুরু হয় ১৯৮৪ সালে। এই জরিপ এখনও চলছে। যেসব এলাকায় শেষ হয়েছে, সেখানে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি।
মাঠ কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা এবং অসতর্কতায় ভুলে ভরা ভূমি জরিপের খেসারত গুনতে হচ্ছে জমির মালিকদের। পরচা আর মানচিত্রে কেবল ভুল আর ভুল। কারও জমি পরচায় আছে তো মানচিত্রে নেই। আবার মানচিত্রে থাকলেও হয়তো তা পরচায় নেই।
জরিপে জমির মালিকের নামের ভুল, নামের বানানে ভুল, জমির পরিমাণে ভুল এবং গরমিলসহ অসংখ্য ত্রুটি রয়ে যাচ্ছে। যুগের পর যুগ ভোগদখল করে এলেও জরিপে প্রকৃত মালিকের পরিবর্তে নাম দেখানো হয়েছে অন্য ব্যক্তির। এসব কারণে ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। সব ধরনের খতিয়ানে ব্যক্তির নাম থাকার পরও কোনো জমি যদি সরকারের নামে রেকর্ডভুক্ত হয় এবং ট্রাইব্যুনাল সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেন, তাহলে তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নামে নামজারি করে দিতে হবে। কিন্তু এ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনালের কোনো রায়ের পর নামজারি করে দিতে দেখা যায়নি।
যেভাবে ভোগান্তিতে বিচারপ্রার্থীরা
২০০৪ সালে আইনটি সংশোধনের পর বগুড়ায় গঠিত ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে ২০০৫ সালের জুন মাসে পরচা ও মানচিত্র সংশোধনের জন্য মামলা করে জেলার শিবগঞ্জ থানার সৈয়দপুর ইউনিয়নের গণকপাড়া গ্রামের নাজিম উদ্দিন।
তার সাড়ে তিন একর জমি অন্য একজনের নামে মানচিত্র ও পরচা হয়ে যায়। দীর্ঘ ১১ বছর শেষে ২০১৬ সালে ট্রাইব্যুনাল তার পক্ষে রায় দেন। রায়ে নতুন করে পরচা ও মানচিত্র তৈরি করে তার নামে করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে তার প্রতিপক্ষ আহসান হাবীব একই বছরের জুলাই মাসে হাইকোর্র্টে রিট করলে আদালত রায়টির ওপর স্থগিতাদেশ দেন। একইসঙ্গে ওই রায় কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট সংশ্লিষ্টদের প্রতি চার সপ্তাহের রুল জারি করেন।
হাইকোর্র্টে নাজিম উদ্দিনের আইনজীবী আব্দুল লতিফ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, পাঁচ বছর হয়ে গেলেও ওই রুল শুনানি করা যায়নি।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের যে বেঞ্চ ট্রাইব্যুনালের রায় স্থগিত করে আদেশ দিয়েছেন, ওই আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ায় সেখানে রুলের চূড়ান্ত শুনানি সম্ভব হয়নি। এরপর আরও কয়েকটি বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানির চেষ্টা করলেও তা মামলা শুনানি তালিকায় আনা সম্ভব হয়নি।
আইনজীবী আব্দুল লতিফ বলেন, কবে নাগাদ এই রুলের চূড়ান্ত শুনানি হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। তবে তার মক্কেল নাজিম উদ্দিনের পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ওই সাড়ে তিন একর জমি এখন পর্যন্ত ভোগদখল করছে প্রতিপক্ষ আহসান হাবীব।
আব্দুল লতিফ বলেন এরকম মামলাগুলোর অধিকাংশের একই অবস্থা।
ট্রাইব্যুনালে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণ
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ টিবিএসকে বলেন, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা হওয়ার এক বছরের মধ্যে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেটি হচ্ছে না। কারণ, এখন পর্যন্ত অনেকগুলো ট্রাইব্যুনালে বিচারক নেই।
আবার মামলার এক পক্ষের সাথে ভূমি জরিপ অধিদপ্তর, থানা ভূমি অফিস, জেলা প্রসাশকের কার্যালয় জড়িত থাকে। দেখা যায়, মামলা হওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অন্তবর্তীকালীন আদেশ বা ডিক্রি আসলে সেগুলো বাস্তবায়ন করা বা মামলার বিচারকাজে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ভূমি সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিচারকের দক্ষতাও বড় বিষয়। কিন্তু এসব ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে সরকারের পক্ষ থেকে সেভাবে উদ্যোগ নেই। ফলে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকছে।
নেই আপিল ট্রাইব্যুনাল
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী আবদুল বাসেত মজুমদার টিবিএসকে বলেন, ভূমি জরিপ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালে মামলার যেকোনো আদেশের বিরুদ্ধে আপিলেট ট্রাইব্যুনালে যেতে হবে। সংশোধীত রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ এর ১৪৫(বি) ধারায় আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রয়েছে।
কিন্তু, এ পর্যন্ত আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়নি। এ কারণে বিচারপ্রার্থীদের ট্রাইব্যুনালের যেকোনো আদেশ বা রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট আবেদন করতে হয়।
উচ্চ আদালতে যাওয়া অনেক ব্যয়বহুল। আপিলেট ট্রাইব্যুনাল গঠন হলে ব্যয় ও সময় কম লাগত। হাইকোর্টে কম সময়ের মধ্যে আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েন বিচারপ্রার্থীরা।
তিনি বলেন, এসব রিট যেমন দিনের পর দিন চলতে থাকে, তেমনি রিট নিষ্পত্তি না হওয়ায় ট্রাইব্যুনালে দায়ের হওয়া মামলাগুলোও নিষ্পত্তি হয় না। ফলে মামলার জট বাড়ছে। আপিলেট ট্রাইব্যুনাল থাকলে বিচারপ্রার্থীরা তাত্ক্ষণিক প্রতিকার পেত।
মানা হয়নি হাইকোর্টের রায়
ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল না থাকায় তা কেন দ্রুত করা হবে না তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট ২০১৫ সালে সরকারের প্রতি স্যুয়োমোটো রুল ইস্যু করে। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই এক যুগান্তকারী রায় দেন তিন বিচারপতির সমন্বয়ে হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ। রায়ে ৯০ দিনের মধ্যে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয় আইন ও ভূমি মন্ত্রণালয়কে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, "দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দেশের মালিক তথা জনগণকে তার অইনসম্মতভাবে প্রাপ্ত অধিকার থেকে তথা আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিল মামলা দায়েরের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার যেমন লঙ্ঘিত হচ্ছে, তেমনি সুবিচার থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং সচিব আপিল ট্রাইব্যুনালে বিচারক নিয়োগ না দিয়ে জনগণের সাথে অমানবিক, নিষ্ঠুর এবং ক্ষমার অযোগ্য আচরণ করেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এবং সচিব দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।"
ঝুলে আছে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ
হাইকোর্র্টের রায়ের পর আইন সংশোধন করে যুগ্ম জেলা জজদের পাশাপাশি সিনিয়র সহকারী জজ ও সহকারী জজদেরও ভূমি জরিপ ট্রাইব্যুনালের মামলা শুনানির এখতিয়ার দেওয়ার বিধান করার উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ক্ষমতা জেলা জজ আদালতকে দেওয়ার কথা। এ লক্ষ্যে ১৯৫০ সালের রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইনের সংশ্নিষ্ট ধারা সংশোধনে একটি খসড়া প্রজ্ঞাপন প্রস্তুত করে ভূমি মন্ত্রণালয়। ওই খসড়া চূড়ান্ত করতে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি একটি উপ-কমিটি গঠন করে। কিন্তু এতোদিনেও সেই খসড়া আলোর মুখ দেখেনি।
ভূমি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. মকবুল হোসেন এমপি টিবিএসকে বলেন, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে ও আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনে ভূমি মন্ত্রণালয় সবসময় উদ্যাগী।
তিনি বলেন, "বিচারক নিয়োগ দেওয়া ও কোর্ট দেখা শুনার দায়িত্ব আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের। ভূমি, মন্ত্রণালয় চাইলেও সরাসরি কিছু করতে পারবে না।"
মকবুল হোসেন আরও বলেন, 'ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে আমরা আইনের খসড়া ২০১৯ সালে আইন মন্ত্রণালয়কে দিয়েছি। এখন পর্যন্ত সেটি চূড়ান্ত হয়নি। আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের সাথেও কথা বলেছি।'
খসড়াটি চূড়ান্ত করতে আইন মন্ত্রণালয়ের গঠিত উপ-কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী টিবিএসকে বলেন, "কাজ প্রায় শেষ দিকে। আশা করা যায় দ্রুত তা জাতীয় সংসদে বিল আকারে উপস্থাপন করা যাবে।"