মহাবিপদের সঙ্কেত! তবু আমরা কি প্রস্তুত?
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হার মারাত্মক গতি ধারণ করায় গেল বছরের মতো জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে ফের কড়াকড়ি আরোপের ব্যাপারে গত বৃহস্পতিবার সতর্ক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বৃহস্পতিবারই (১ এপ্রিল) বাংলাদেশে এপর্যন্ত সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণের রেকর্ড হয়। একদিনেই শনাক্ত হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার, যেখানে গেল বছরের মার্চে দেশে প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের সময় ধরা পড়েছিল মাত্র ৩টি কেস। মৃত্যুর সংখ্যাও পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়, বৃহস্পতিবার নাগাদ প্রাণ গেছে ৫৯ জনের। বিগত কয়েক মাসেও দেশে এমন গুরুতর অবস্থা দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রীর একদিন আগে বুধবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীও উদ্বেগ প্রকাশ করে বর্তমান পরিস্থিতি "আমাদের জন্য লাল সংকেত" বলে উল্লেখ করেন।
বুধবারের চেয়েও বেশি সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ায় বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেককে আরও বেশি বিচলিত দেখায়। তিনি বলেন, "প্রতিদিন ৫০০-১০০০ রোগী হাসপাতালে জরুরীভাবে ভর্তি হতে আসতে থাকলে, গোটা ঢাকা শহরও রোগী ধারণ করার পক্ষে যথেষ্ট হবে না।"
প্রাণঘাতী জীবাণুর বিরুদ্ধে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়া এই ব্যক্তিটি এখন হাসপাতাল ব্যবস্থা রোগীর চাপে ভেঙ্গে পড়ার আগেই জনজীবনে অতিদ্রুত ভিত্তিতে কড়াকড়ি ব্যবস্থার আরোপ চাইছেন।
বাস্তবতা হলো, আরও দুই সপ্তাহ আগেই বিপদের লাল ঝাণ্ডা উঁচিয়ে সতর্ক করা হয় তার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে। কারখানায় কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনাসহ, সন্ধ্যে ৬টার মধ্যে দোকান বন্ধের মতো বেশ কিছু জরুরী সুপারিশ করে পাঠানো হয় প্রস্তাবনা।
দেরিতে হলেও এসব বিধিনিষেধের কিছু কিছু হুটহাট করে আরোপ করা হয়েছে, ফলে সেগুলো কার্যকর হবে কিনা- তা নিয়েও দেখা দিয়েছে সন্দেহ।
এমনই একটি ব্যবস্থা হলো ভ্রমণে কড়াকড়ি। এর আওতায় গণপরিবহনে জড়িত বাসগুলোকে অর্ধেক সিট ফাঁকা রেখে যাত্রী পরিবহন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু, অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় তাতে করে চরম দুর্ভোগে পড়ছেন নিয়মিত যাত্রীরা। তাদের ভেতর সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে।
আইসিইউ শয্যা ফুরিয়ে আসায় সামনের সপ্তাহগুলো আরও বিপজ্জনক হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। মহামারি বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ভাইরাস এখন ইউকিউবেশন পিরিয়ডে আছে এবং আগামী দুই সপ্তাহে আরও অনেক বেশি মানুষের মধ্যে অতিদ্রুত ছড়াবে।
কোনো জীবাণুর ইউকিউবেশন পিরিয়ড হলো ওই জীবাণু সংক্রমণের শিকার ব্যক্তির মধ্যে রোগের উপসর্গ দেখা দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত একটি নির্দিষ্ট সময়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ রোগ সৃষ্টিকারী সার্স কোভ-২ জীবাণুর ক্ষেত্রে ভাইরাসের এই সুপ্তাবস্থা ৫-৬ দিন থেকে সর্বোচ্চ দুই সপ্তাহ পর্যন্ত থাকে।
আর হাসপাতালের করোনাভাইরাস ইউনিটে রোগীর জন্য শয্যা যোগাড় করা ইতোমধ্যেই রোগীর স্বজনদের জন্য অসাধ্য সাধনের সমান হয়ে উঠেছে। কোভিড ইউনিটে শয্যা আছে সাড়ে ৩ হাজার, মার্চের শুরুতে রোগী ভর্তি ছিল এক হাজারেরও কম শয্যায়। আর গেল বৃহস্পতিবার নাগাদ এসব শয্যার মধ্যে ২,৮৭৬টি'ই ছিল পূর্ণ। কিছু শয্যা খালি দেখা গেলেও, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা সেগুলো ভর্তি বলে জানান।
চিকিৎসকরাও উদ্বিগ্ন, তাদের উদ্বেগের সবচেয়ে বড় কারণ আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা আগের চেয়েও মারাত্মক। ফলে ইতোপূর্বে দেওয়া চিকিৎসাগুলো ব্যবহার করে এখন তেমন ফল পাচ্ছেন না তারা। এতে রোগীর স্বাস্থ্যও দ্রুত অবনতির দিকে যাচ্ছে।
তাই এখন চিকিৎসা বহির্ভূত ব্যবস্থাই হয়ে উঠেছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধের লড়াইয়ে প্রাথমিক হাতিয়ার, ইতোপূর্বে, গেল বছরে এই প্রক্তিয়া অনুসরণ করে কয়েক মাসব্যাপী লকডাউন আরোপ করে অনেক দেশ। সাধারণ ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে শাটদাউনের ছদ্মবেশে গত বছরের ২৫ মার্চ থেকে টানা দুই মাস বাংলাদেশও নিজস্ব সংস্করণের লকডাউন চালু করে।
চলতি সপ্তাহে তেমন কিছু নিষেধাজ্ঞা এর মধ্যেই আরোপ করা হয়েছে- গণপরিবহণ ও জনসমাবেশের ওপর। কিন্তু, প্রধানমন্ত্রী এর চাইতেও বড় কিছুর আভাস দিয়েছেন। দেশ আরেকটি শাটদাউনের মধ্যে পড়বে কিনা-তা নিয়ে যথেষ্ট গুঞ্জন চলছে, এরমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আভাস ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সতর্কবাণী আমাদের সামনে লকডাউনের পদক্ষেপকে আরও অবশ্যসম্ভাবী করে তুলেছে।
এবং সত্যি বলতে কী মানুষজনের একত্রিত হওয়া ঠেকাতে কর্তৃত্ববাদী বিধিনিষেধের মতো চিকিৎসা বহির্ভূত পন্থাই হচ্ছে জীবাণুর বিস্তার ঠেকানোর সেরা উপায়। কিছু পদক্ষেপ এরমধ্যেই নেওয়া হয়েছে, সামনে আরও আসছে।
ইতোমধ্যেই, যুক্তরাজ্য ও ১২টি দেশ বাদে ইউরোপের বাকি দেশগুলো থেকে যাত্রীদের আগমনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ। ইউরোপে সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার কারণেই এই পদক্ষেপ। আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আগামী ৩ থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত বহাল থাকবে।
দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মহানগরী চট্টগ্রামে আগামী ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত জনসমাগম সীমিত করা হয়েছে। সকল পর্যটন স্থাল, বিনোদন কেন্দ্র ও কমিউনিটি সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
বৃহস্পতিবার সংক্রমণ ঠেকাতে অবিলম্বে বইমেলাসহ সব ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠান ও বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ রাখার সুপারিশ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি।
বিদ্যালয়গুলো বন্ধ রয়েছে এবং পুনরায় চালুর সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
গত বুধবার প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সম্প্রচারিত এক ভিডিও কনফারেন্সে জেলা প্রশাসনগুলোর প্রতি স্বাস্থ্য বিধি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়। গেল বছর সংক্রমণের প্রথম ঢেউ আঘাত হানার সময় যেভাবে সচিবদের জেলা পর্যায়ে ত্রাণ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, অচিরেই তাদের সেই দায়িত্ব আবার দেওয়া হতে পারে।
জেলা প্রশাসনগুলোকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তাদেরকে গত ২৮ মার্চ ঘোষিত গাইডলাইন আগামী দুই সপ্তাহ মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'কে বলেন, "এখনও নতুন কোনো গাইডলাইন পরিকল্পনা করা হয়নি।"
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার (মিডিয়া) ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, জনগনের মধ্যে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সচেতনতা বাড়াতে সরকার ঘোষিত ১৮ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে পুলিশ।
তবে এখনও কারখানা পরিচালনা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে আকস্মিকভাবে সংক্রমিত ও মৃতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়, কোনো প্রস্তুতি নেওয়ারই সময় পায়নি অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।
বিবিএস কেবলস লি. এর চেয়ারম্যান এবং স্টিল বিল্ডিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ইঞ্জি. আবু নোমান হাওলাদার বলেন, "দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। দেশে টিকাদান শুরু হওয়ার পর আশা করেছিলাম জীবাণুর বিস্তার কমবে এবং সেই অনুসারে উৎপাদন চুক্তিও করেছি।"
"সংক্রমণ হার যখন বাড়ছিল, তখনও আমরা স্বাস্থ্য বিধি অনুসরণ করে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই।" গত বৃহস্পতিবার টিবিএস'কে এসব কথা বলার সময় তিনি সরকারের প্রতি এই দুঃসময়ে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার উপায় খুঁজে বের করার অনুরোধ করেন।
শাশা ডেনিমস লি.- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি'র সাবেক প্রেসিডেন্ট শামস মাহমুদ বলেন, বায়াররা সবে নতুন ক্রয়াদেশ নিয়ে আসা শুরু করেছিলেন, কিন্তু সংক্রমণের নতুন ঊর্ধ্বগতি পোশাক শিল্পকে আবারও সঙ্কটের মুখে ঠেলে দিল।
পোশাক শিল্প সবচেয়ে শ্রমঘন হওয়ায় এখাতের উদ্যোক্তারা এখন উদ্বিগ্ন, তারা এখন গেল বছর প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার সময় নেওয়া স্বাস্থ্য সতর্কতার পদক্ষেপগুলো আবার চালুর প্রতি মনোযোগ দিচ্ছেন।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের একজন পরিচালক ফজলে শামীম এহসান বলেন, "ভুল-ত্রুটি থেকে ক্ষা নিয়ে আমরা এখন মহামারির বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।"
তিনি জানান, পোশাক কারখানাগুলো স্বাস্থ্য বিধি রক্ষা করতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে, যেকারনে অ্যাপারেল শিল্পে মৃত্যুর হার এক পর্যায়ে শূন্যে নেমে আসে। ইতোমধ্যেই, কারখানাগুলো ৭০-৭৫ শতাংশ সক্ষমতায় পরিচালনা করা হচ্ছে, বলেও জানান তিনি।
(সংক্ষেপিত)
বিস্তারিত মূল প্রতিবেদনটি ইংরেজিতে পড়ুন: Red signal raised. Are we prepared?