মহামারির শেষ কি আসন্ন?
করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন চলে আসা- সব দিক থেকেই অসাধারণ একটি ব্যাপার। অন্যান্য অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও মানুষ টিকাকেন্দ্রগুলোতে জীবনরক্ষাকারী ভ্যাকসিনের ডোজ নিতে ছুটে যাচ্ছেন।
জনসাধারণের প্রতিক্রিয়াও সন্তোষজনক। এপর্যন্ত ৩৭ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন।
তবে কি আমরা এখন ধরে নিতে পারি যে কোভিড-১৯ মহামারি শেষের পথে? উত্তর হল: জটিল এই প্রশ্নটির জবাব শুধু 'হ্যাঁ' বা 'না'র মাধ্যমে দেওয়া সম্ভব নয়। এমনকি এর উত্তর দুটিই হতে পারে। সকল সম্ভাবনা বিবেচনায় করোনাভাইরাস আরও কয়েক বছর- এমনকি কয়েক দশক ধরে এর অস্তিত্ব লুকোচুরির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছবে, এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাহলে এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাকসিন আলাদা কী ভূমিকা রাখবে? উত্তর হল, অনেক কিছুই।
উদাহরস্বরূপ, কোভিড-১৯ মহামারির হিসেবে নয় বরং স্থানীয় রোগ হিসেবে টিকে থাকবে। এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্যও অনেক। যখন কোনো একটি সংক্রামক রোগ দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তা হলো মহামারি। স্থানীয় রোগ বা এনডেমিক হল, রোগটি যখন এইচআইভি বা ম্যালেরিয়ার মতো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে আসে। ব্যাপারটি তখনও চিন্তার কারণ হলেও, খুব বেশি উদ্বেগজনক নয়।
কোভিড-১৯ আক্রান্তদের মৃত্যুবরণ ও হাসপাতালের ভর্তি হওয়া কমাবে ভ্যাকসিন, অবশ্যম্ভাবীভাবেই ভাইরাসের বিপদের মাত্রা কমে আসবে। সংক্রমণও চলে আসবে সহনীয় পর্যায়ে।
বিশ্বজুড়ে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে অহরহ। টিকাদান কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর ইসরায়েলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা কমেছে ৩০ শতাংশ। মহামারির আঘাতে বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর সংখ্যা সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়েছে অনেক আগেই, টিকাদান শুরু হওয়ার পর সেখানেও সংক্রমণ হার কমে আসছে। এটি আর্থিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ হাসপাতালগুলোয় পরিষেবা ব্যবস্থার পেছনে এরফলে খরচ কমেছে।
ফলে মানুষ আবারও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে। আশা করা যায় আগের চেয়ে দ্রুতই অর্থনীতিও ঘুরে দাঁড়াবে।
তবে ভাইরাসের নতুন স্ট্রেইনের মতোই দ্রুত নতুন উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে। তবে এটি অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল এমনও নয়। অন্য যেকোনো জীবের চেয়ে ভাইরাসের মধ্যেই ডারউইনের বিবর্তনবাদ স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান। কোভিড-১৯ আক্রান্ত মানুষের দেহে অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ায় ভাইরাসের অস্তিত্বও সংকটের মুখে পড়ে। এ প্রক্রিয়া চলমান থাকলে বেঁচে থাকতে নতুন কোনো পোষক দেহ খুঁজে পাবে না ভাইরাস। একারণেই বিবর্তনের দিকে এগোয় অণুজীবটি, কোষের প্রোটিন কাঠামো বদলে তৈরি হয় একই ভাইরাসের নতুন ধরন।
দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে আবির্ভূত হওয়া সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের অন্তত নতুন দুটি ধরন- এখন পর্যন্ত সবচেয়ে মারাত্মক ও অতি-সংক্রামক বলে প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের কেন্ট অঞ্চলে পাওয়া ধরনটিও বেশ ক্ষতিকর।
নতুন ধরনের বিরুদ্ধে বিদ্যমান ভ্যাকসিনগুলোও কিছুটা কম কার্যকর। বিজ্ঞানীরা নতুন ধরনের বিরুদ্ধে অধিক কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করার আগে এই ধরনগুলো উদ্বেগের কারণ হয়েই থাকবে।
মহামারিকে স্থানীয় রোগের পর্যায়ে নিয়ে আসার অনেক কিছুই নির্ভর করছে কতো দ্রুত নতুন ভ্যাকসিন তৈরি ও সহজলভ্য হবে তার ওপর, ততোদিন পর্যন্ত ভাইরাসের আরও অসংখ্য নতুন ধরন দেখা যাবে নাকি তার ওপরও নির্ভর করছে অনেক কিছু।
কিন্তু ততোদিন পর্যন্ত মাস্ক পরে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আমদেরই সতর্ক থাকতে হবে।
আমরা এখনই নতুন স্বাভাবিক জীবনে প্রবেশ করেছি, কতোদিন পর্যন্ত এরকম অবস্থা থাকে তাও বলার উপায় নেই। হয়তো আরও কয়েক বছর, দশক বা যুগও লাগতে পারে।
একই সময়কালে বিশ্বের সম্পূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়া বলতে গেলে অসাধ্য সাধনের মতোই ব্যাপার, বিশ্বে আগেও কখনো এটি করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য প্রয়োজন অসাধারণ প্রশাসনিক দৃঢ়তা ও দক্ষতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইউরোপের অনেক উন্নত অর্থনীতির দেশ এ কাজ করতে পারেনি।
ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ও উন্নত দেশগুলোর আগাম বিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন কিনে নেওয়ার ফলে দরিদ্র দেশগুলো প্রথমদিকে ভ্যাকসিন পাচ্ছে না। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক দেশে এখনো টিকাদান শুরুই হয়নি।
অল্প সময়েই ভাইরাসের নতুন ধরনের বিরুদ্ধে অধিক কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলেও সেই সময়ের মধ্যে নতুন ধরনগুলো বেশ কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়লেই টিকাদান কার্যক্রম বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
এর আগে প্রায় চার দশক আগে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বড় পরিসরে টিকাদান কার্যক্রম চালায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অধীনে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও স্মলপক্স নির্মূলে প্রায় দুই দশক সময় লাগে। ১৯৮০'র দশকে স্মলপক্স নির্মূলের আগে পৃথিবীতে তিন হাজার বছর ভাইরসাটির অস্তিত্ব ছিল।
ঠিক কখন কোভিড-১৯ নির্মূল হতে পারে নির্দিষ্টভাবে সেই পূর্বাভাস দিতে পারছেন না মহামারি বিশেষজ্ঞরাও।
একটি ভাইরাসের জীবনকালের ধারণা দিতে তারা যেসব উদাহরণ দিয়েছেন তা একইসাথে আশা ও নিরাশার উদ্রেক করে। তারা জানিয়েছেন এই ভাইরাস কয়েক বছর, এমনকি কয়েক যুগও সংবাহিত হতে থাকবে। ফ্লু, হাম ও এইচআইভির মতোই সমাজে ভাইরাসের সহাবস্থান থাকবে।
১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লু মহামারির কথাই ধরা যাক, বিধ্বংসী ওই মহামারিতে আনুমানিক ৫ কোটি – ১০ কোটির মতো মানুষ মারা যায়। ১৯২০ সাল পর্যন্তও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস হুমকিস্বরূপ ছিল, কিন্তু অনেক কম মানুষই আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তবে এখনো পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়নি ফ্লু ভাইরাস।
১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস কীভাবে ১০০ বছর ধরে বিভিন্ন মহামারিতে ভূমিকা রেখেছে তা ব্যাখ্যা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের দুইজন বিশেষজ্ঞ ডেভিড মোরেনস ও জোফ্রি টোবেনবারগার। ২০০৯ সালে অ্যান্থনি ফাউসির সঙ্গে লেখা তাদের রিপোর্টে এসবের বিস্তারিত ব্যাখা দেওয়া হয়েছে।
"প্রকৃতপক্ষে স্প্যানিশ ফ্লুর পর থেকে ১৯৫৭, ১৯৬৮, ২০০৯ সালের মহামারির ব্যুৎপত্তি হয়েছে ১৯১৮ সালের ফ্লু ভাইরাস থেকে," সম্প্রতি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন জোফ্রি।
"এবছর বা গত বছর মানুষ যে ফ্লু ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন এই ভাইরাসও ১৯১৮ সালের ফ্লু ভাইরাসের সাথে সম্পর্কিত।"
অর্থাৎ কোনো না কোনো অন্য ধরনের ফ্লু ভাইরাস টিকে আছে। তবে মানুষ এর প্রভাব কাটিয়ে এগিয়ে গেছে।
মহামারিবিদ্যার বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস যতো বেশি সময় টিকে ছিল, ততোই আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ও ভাইরাসের প্রাণঘাতী বৈশিষ্ট্য কমে যায়।
ভ্যাকসিনের কারণে কোভিড-১৯ মহামারি নিয়ে এই একই ধারণাই করছেন মহামারিবিদরা।
- মূল নিউজ: Is the end in view?
- অনুবাদ: রাফিয়া তামান্না