মৌলভীবাজারে কমিউনিটি ট্যুরিজমের রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা
অভাব লেগেই থাকতো পরিমল সিংহের ঘরে। তবে ২০১৮ সালে সরকারি উদ্যোগ নেওয়া একটি প্রকল্প বদলে দিয়েছে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাঝেরগাও গ্রামের এই মণিপুরী বাসিন্দার ভাগ্য।
ওই বছর মণিপুরী অধ্যুষিত মাঝেরগাও গ্রামে কমিউনিটি ট্যুরিজমের একটি পাইলট প্রকল্প চালু করেন সিলেটের তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার। এই প্রকল্পের একজন সুবিধাভোগী পরিমল। নিজ বাড়িতেই পর্যটকদের জন্য আলাদা একটি কক্ষ তৈরি করেন তিনি। সেখানে দুটি বিছানায় একসাথে চারজন পর্যটক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
মণিপুরী সংস্কৃতি ও জীবনচারণ কাছ থেকে দেখার সুযোগ নিতে পরিমলের তৈরি এই কক্ষে প্রায়ই আসেন পর্যটকরা। এতে স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করে তার সংসারে।
পরিমল বলেন, "পর্যটকদের কারণে আমার অভাব দূর হয়েছে।"
এই কক্ষে একদিন থাকা ও খাওয়ার জন্য একজন পর্যটকের খরচ হয় ১৭০০ টাকা। এতে তার হাজারখানেক টাকা লাভ হয় বলে জানান পরিমল। কেবল পরিমলই নন, এই উদ্যোগের ফলে লাভবান হয়েছেন ওই গ্রামের অন্তত ৩০ মণিপুরী পরিবার।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও কমিউনিটি ট্যুরিজমের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষত আধিবাসী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এরকম উদ্যোগ নেওয়া হলে তাদের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনচারণ দেখতে দেশিয় পর্যটকদের পাশপাশি বিদেশিরাও আসবেন। এতে আর্থিকভাবে সঙ্কটে থাকা নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠীর স্বচ্ছলতাও আসবে।
পর্যটনের সাথে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মারমা, খাসিয়া, গারো, ত্রিপুরা, মুন্ডা, সাঁওতাল ও মণিপুরীসহ বিভিন্ন নৃতাত্তিক জনগোষ্ঠির বসবাস মৌলভীবাজারে। তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোকে ঘিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন পর্যটকেরা। মনিপুরী গোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় অনুষ্ঠান রাসলীলাকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর লাখো মানুষের জমায়েত ঘটে কমলগঞ্জে। একই ভাবে খাসিয়েদের বর্ষবরণ বা গারোদের নিজ্বস্ব অনুষ্ঠানও পর্যটকদের মধ্যে সারা ফেলেছে। ফলে এ জেলায় কমিউনিটি ট্যুরিজমের জন্য ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
কমিনিউটি ট্যুরিজম জনপ্রিয় করতে হলে শুধু উদ্যোগ নিয়ে থেমে না থেকে বিশ্বব্যাপী তা প্রচার করতে হবে বলে জানান বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটোর এসোশিয়েসনের প্রেসিডেন্ট মো. রাফিউজ্জামান। তিনি বলেন, "আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ এবং ভারতে এই কমিউনিটি ট্যুরিজম খুব জনপ্রিয়। বাংলাদেশের নৃতাত্তিক গোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতিও সহজেই পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো। তবে কমিউনিটি ট্যুরিজমের উন্নয়ন করতে হলে দেশে এবং দেশের বাইরে এই সেক্টরকে প্রমোট করতে হবে। স্থানীয়দের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে ট্যুরিজম বান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।"
কমলগঞ্জের মাঝেরগাও গ্রামের কমিউনিটি ট্যুরিজমের সাথে সংশ্লিস্ট কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৮ সালে এই প্রকল্প শুরুর পর সরকারি উদ্যোগে তাদেরকে পর্যটকদের নিরাপত্তা, খাবার, বাসস্থানসহ সার্বিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। এছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে অন্য কিছু সহায়তাও দেওয়া হয় তাদেরকে। এমনকি একটি কমিটিও গঠন করে দেওয়া হয়।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, বর্তমানে এই কমিউনিটি ট্যুরিজম কমিটির সদস্য ৮০ জন। এরমধ্যে ১০ জনের বাড়িতে পর্যটক থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এসব বাড়িতে প্রতিদিন ২০ জন পর্যটক থাকতে পারেন।
এই গ্রামের কমিউনিটি ট্যুরিজম কমিটির সদস্য রাজু সিংহ জানান, ২০১৯ সালের পর তিনি নিজের বাড়িতে পর্যটকদের জন্য দুটি আলাদা কক্ষ তৈরি করেছেন। তার বাড়িতে থাকতে নিয়মিত পর্যটক আসেন বলে জানান তিনি। বিশেষ করে বিদেশি পর্যটকরা এতে খুব আনন্দিত হন। মণিপুরীদের ঐতিহ্যগত খাবার এবং তাদের বিভিন্ন পুরাতন জিনিসপত্র দেখতেই আসেন এসব পর্যটক। তাছাড়া, পর্যটক আসলে গ্রামে মণিপুরী নৃত্যসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, "কোনো পর্যটক চাইলে এখানে মণিপুরীদের ঐতিহ্যবাহী পোষাক পরতে পারেন। ইচ্ছে করলে আমরা দৈনন্দিন যে কাজগুলো করি সেগুলোতেও তারা সম্পৃক্ত হয়ে অভিজ্ঞতা নিতে পারেন।"
অব্যবহৃত সম্ভাবনা
শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, পর্যটন মৌসুমে শুধু শ্রীমঙ্গল উপজেলাতেই প্রতিদিন ৫ হাজার পর্যটক আসেন। এই সব পর্যটকদের কমিনিউটি ট্যুরিজমে আকৃষ্ট করতে পারলে এই এলাকার পর্যটন বদলে যাবে।
মৌলভীবাজারের নৃতাত্তিক গোষ্ঠীরা যুগ যুগ ধরে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করছেন। তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রয়েছে। এসব মানুষের বেশিরভাগেরই জীবিকার প্রধান ক্ষেত্রে পান চাষ। কিন্তু পানের জুম কমে আসায় সংকটে পড়ছেন তারা। এসব জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প আয়ের ক্ষেত্র হতে পারে কমিউনিটি ট্যুরিজম।
এই গ্রামের উদ্যোক্তারা জানান, কমিউনিটি ট্যুরিজমের এই উদ্যোগ পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। সরকারের সমর্থন পেলে এটি আরও এগিয়ে যাবে। উদাহরণ হিসেবে তারা মণিপুরী নৃত্যে ব্যবহৃত পোষাকের কথা বলেন। এসব পোষাকের দাম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা । এত দামী পোষাক তারা কোন কারণে ভাড়া আনলে সেখানে খরচ হয় ১০০০ টাকা। তাই ইচ্ছে থাকলেও তারা সবসময় নিজেদের ঐতিহ্য তুলে ধরতে পারছেন না। এসব ক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা চেয়ে উপজেলা প্রশাসনের কাছে আবেদনও করেছেন গ্রামের বাসিন্দারা।
মাঝেরগাওয়ের মনিপুরী কমিউনিটি ট্যুরিজমের পরিচালক নিরঞ্জন সিংহ রাজু বলেন, "দেশী পর্যটকের চাইতেও বিদেশিরা পর্যটকরা আমাদের আয়োজনে খুশি। তারা আমাদের নিজস্ব খাবার, ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি খুব পছন্দ করেন। এ থেকে মাসে প্রায় কোটি টাকার ব্যবসা করা সম্ভব।"
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, "আমাদের একটি সার্ভে অনুযায়ী বর্তমানে শ্রীমঙ্গলের অর্থনিতির ৪০ শতাংশ পর্যটন নির্ভর। এ থেকে ২০ হাজার মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়।"
তাদের জরিপ অনুযায়ী, প্রতিদিন ৫ হাজার পর্যটক শ্রীমঙ্গল ঘুরতে আসেন। কমিনিউটি ট্যুরিজমের প্রচার ঘটিয়ে মাসে ১৫০০ দেশি এবং ৫০০ বিদেশি পর্যটক আকৃষ্ট করা গেলে শুধু মৌলভীবাজারের অর্থিনীতিতে মাসে আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা যুক্ত হতে পারে পারে। বছরে কম করে হলেও ১০০ থেকে ২০০ কোটি টাকা আয় হতে পারে এই অঞ্চল থেকে।
এদিকে কমিউনিটি ট্যুরিজমকে জনপ্রিয় করতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন পর্যটনখাতের সংশ্লিষ্টরা। লাউয়াছড়া খাসিয়া পুঞ্জির প্রধান ও সিলেট আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ফিলা পত্মি জানান, সরকার সহযোগিতা করলে মৌলভীবাজারের ৭৫টি খাসিয়া পুঞ্জিসহ সিলেট বিভাগের ৮০ টি পুঞ্জি কমিউনিটি ট্যুরিজমে যুক্ত হতে পারে। এতে আমাদের অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে এবং আয়ের বিকল্প পথ তৈরী হবে।"
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. মেহেদী হাসান জানান, "কমিউনিটি ট্যুরিজম বিকশিত করতে পারলে সেটা খুবই ভাল হবে। আমরা এ নিয়ে কাজ করব। নৃতাত্তিক গোষ্ঠীর বিকল্প আয়ের একটি বড় মাধ্যেম হতে পারে কমিউনিটি ট্যুরিজম।"