ময়মনসিংহে করোনা চিকিৎসা দিচ্ছে না প্রাইভেট হাসপাতালগুলো
"অক্সিজেন সমস্যার কারণে হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা সবগুলো ব্যবহার করতে পারছিনা। প্রতিদিন যে পরিমাণ রোগী ভর্তি হচ্ছে তা আমাদের সক্ষমতাকে অতিক্রম করেছে। সাধারণ শয্যাই দিতে পারছিনা। রোগীর স্বজনদের আহাজারি দেখে মন খারাপ হয়। আমি অসহায়; সকলের সদিচ্ছা ও চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও আমরা কাঙ্খিত সেবাটা দিতে পারছিনা", এভাবেই করোনা চিকিৎসা নিয়ে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ ফজলুল কবির।
সরকারি হাসপাতালে যখন এই অবস্থা। তখন কী করেছে ময়মনসিংহ শহরের দুই শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো? বাস্তবতা হচ্ছে এই সংকটে এগিয়ে আসেনি একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানও। কোন হাসপাতালেই হচ্ছে না কোভিড চিকিৎসা। তাই সবাইকে ভিড় করতে হচ্ছে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সক্ষমতার অযুহাতে কেউ করাচ্ছেনা করোনা চিকিৎসা।
ময়মনসিংহ বিএমএ সভাপতি ডা. মতিউর রহমান ভুঁইয়া বলেন, "যখন কোভিড ছিলোনা তখন অনেকে ময়মনসিংহে হাসপাতাল দিয়ে ব্যবসা করেছেন, সরকারের সুযোগ সুবিধা নিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু যখন জনগনকে কিছু দেয়ার সময় এসেছে তখন তারা হাত গুটিয়ে রেখেছেন। 'প্রস্তুতি নেই', এটা কোন অযুহাত হতে পারেনা। রাতারাতি তো পরিস্থিতি খারাপ হয়নি। হাতে গোনা কয়েকজন হাসপাতাল মালিক করছেন তাও ব্যক্তিগত পর্যায়ে। তবে নিজের হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেন না। সময় পাওয়া গিয়েছিলো, তাদের উচিৎ ছিলো এই মহামারিতে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর"।
ময়মনসিংহে দিনদিনই খারাপ হচ্ছে করোনা পরিস্থিতি। চাপ বেশি থাকায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৩০টি শয্যা থেকে ৪০২টিতে উন্নীত করা হলেও শয্যা পাচ্ছেনা রোগীরা। এরমধ্যেই দেখা দিয়েছে অক্সিজেন সংকট। বর্তমানে সিলিন্ডারের স্বল্পতা ভাবিয়ে তুলেছে ময়মনসিংহ স্বাস্থ্য বিভাগকে। এরই মধ্যে ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন অক্সিজেন সিলিন্ডার ধার চেয়ে শহরের প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিকগুলোকে দুই দফা চিঠি দিয়েও কাঙ্ক্ষিত সাড়া পায়নি। জেলা সিভিল সার্জন বলেন, "আমরা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর কাছ থেকে সাহায্য চেয়েছিলাম কিন্তু তা পাইনি। হাতেগোনা কয়েকজন এগিয়ে এসেছে, অথচ বড় একটা অংশ কোন সাড়া দেয়নি"।
এমন মহামারিতে কি কিছুই করার নেই বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোর- প্রশ্ন রাখা হয় বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনোস্টিক ওনার্স এসোসিয়েশনের ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি ডা. হরিশংকর দাশের কাছে।
তিনি বলেন, "আমরা চেষ্টা করছি। গত ২৬ জুলাই অক্সিজেন সিলিন্ডার চেয়ে সিভিল সার্জন চিঠি দেয়ার পর আমরা আমাদের সংগঠনের প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ করেছি; তাতেও কাজ না হওয়ায় আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আলাদা চিঠি দিয়েছি। তবে তেমন সাড়া পাইনি। দ্বিতীয়বার গত ১০ আগস্ট আরেকটি চিঠি হাতে পেয়েছি"।
একটিও প্রাইভেট হাসপাতালে কেন কোভিড চিকিৎসা হচ্ছেনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "ময়মনসিংহের হাসপাতালগুলো আসলে প্রাইভেট প্র্যাক্টিস নির্ভর তাই কোভিড চিকিৎসা নিয়ে তারা আগ্রহী না। তারা মনে করছে, কোভিড চিকিৎসা দিলে তারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাছাড়া সব হাসপাতালে আইসিইউ নেই। এটা একটা সমস্যা। তবে আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে কাজ করছি দ্রুত ব্যবস্থা করার"।
এদিকে পরিচয় না দেয়ার শর্তে ময়মনসিংহের একটি হাসপাতালের মালিক বলেন, "বেসরকারি ডাক্তার-নার্সরা কোভিড ওয়ার্ডে ডিউটি করতে আগ্রহী না। এখানে কোন প্রণোদনারও ব্যাবস্থা করা সম্ভব না। তাই করোনা ওয়ার্ড খুললেও ডাক্তার, নার্স সংকটে পড়তে হবে। এই বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের বা স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে কথা বলাও সমস্যা। তাহলে হাসপাতালে ডাক্তাররা আসবেনা বা অন্য হাসপাতালে চলে যাবে"।
কমিউনিটি-বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ময়মনসিংহের একমাত্র বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সম্প্রতি ৫০ শয্যা নিয়ে চালু করেছে করোনা ওয়ার্ড। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি অক্সিজেন সংকটের কারণে বাড়ানো যাচ্ছেনা শয্যা। হাসপাতালটির পরিচালক প্রফেসর ডা. করিম খান বলেন, "আমরা পারছিনা কারণ আমাদের সেন্ট্রাল অক্সিজেন নেই। সিলিন্ডার অক্সিজেনেরও সংকট আছে। তিনি সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, কেউ যদি অক্সিজেনের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসে তাহলে দ্রুত সমস্যার সমাধান হতো"।
কমিউনিটি-বেজড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের এমন বক্তব্যের জবাবে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা চিকিৎসা বিষয়ক ফোকাল পার্সন ডা. মো: মহিউদ্দিন খান বলেন, "কোভিড চিকিৎসা শুরুর বিষয়ে হাসপাতালটির গাফিলতি ছিলো। এতোদিন ধরে আমরা কোভিড নিয়ে ভুগছি। এতোদিনেও কি পরিকল্পনা প্রস্তুতি তারা নিতে পারেনি ? মৃদু ও মাঝারি উপসর্গের রোগীদের তো তারা চিকিৎসা দিতে পারে! সেন্ট্রাল অক্সিজেন না থাকা এখানে একমাত্র বাঁধা না"।
কোভিড রোগীদের অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেয়ার স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করছেন সুজনের ময়মনসিংহ মহানগরের সম্পাদক আলী ইউসুফ। তিনি বলেন, "আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে যা পাচ্ছি নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছি, তবে যারা এতোদিন রোগ নিয়ে ব্যবসা করে ফুলেফেঁপে উঠলো তারা নিজেদেরকে অযুহাতের চাদরে ঢেকে রেখেছে। এটা কোন কথা হতে পারেনা। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া"।
মুমূর্ষু অবস্থায় দাদাকে নিয়ে টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে এসেছেন শফিকুল ইসলাম। ডাক্তার তার দাদাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করার পরামর্শ দিয়েছেন। আইসিইউয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, "আইসিইউ এর জন্য স্লিপ অনেক জমা হয়ে থাকে। কিন্তু সিট খালি না থাকার কারণে রোগীদের নিতে পারে না। সবার অবস্থা এতটাই খারাপ থাকে, যে কোন সময়ই তারা মারা যেতে পারে৷ আমি দুইদিন আগে আমার দাদাকে আইসিইউতে নেওয়ার জন্য আবেদন করেছি কিন্তু এখনো সুযোগ পাইনি। সিট না পাওয়ার কারণে অনেকেই মারা যাচ্ছে"।
ফজলুল হক নামে এক রোগীর স্বজন বলেন, "আমি হালুয়াঘাট থেকে এসেছি। এখানে ভর্তি হওয়ার পর কোন সিট পাইনি। বাধ্য হয়ে মেঝেতে থাকতে হচ্ছে। এমন অনেকেই আছেন যারা মেঝেতে থাকছেন"।
সিভিল সার্জন অফিসের দেয়া তথ্য বলছে, জেলায় বৃহষ্পতিবার এক দিনে ১ হাজার ৪১৭ জনের নমুনা পরীক্ষায় নতুন করে ৪৩৩ জনের শরীরে করোনার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. নজরুল ইসলাম জানান, সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী ময়মনসিংহে শনাক্তের হার ৩০.৫৫ শতাংশ।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ ফজলুল কবির বলেন, "হাসপাতালে শুধু ময়মনসিংহ বিভাগের নয়, আশেপাশের কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, গাজিপুর থেকেও প্রচুর রোগী আসে। রোগীর চাপ সামাল দেয়া যাচ্ছেনা। তাই বাধ্য হয়ে হাসপাতালের সামনে 'শয্যা খালি নেই' লিখে সাইনবোর্ড টানাতে হয়েছে"। আইসিউতে দক্ষ জনবল, যন্ত্রপাতি আর অক্সিজেন সমস্যার সমাধানে সরকারের উচ্চ মহল হতে সহযোগিতা প্রয়োজন বলে জানান তিনি।