করোনাকালে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে
কোভিড-১৯ একটি ভাইরাল ইনফেকশন হলেও হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় অপ্রয়োজনে অনেক বেশি অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া কোয়াকের পরামর্শে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ওষুধের নাম দেখে বাসায় চিকিৎসা নেওয়া রোগীরা অ্যান্টিবায়োটিক খাচ্ছেন।
কোভিড-১৯ মহামারিতে দেশে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার আগের তুলনায় আরও বেড়েছে। ফলে পরের মহামারি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ও কোভিড গবেষক ডা. তুষার মাহমুদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রচুর রোগী পাওয়া যাচ্ছে, যাদের শরীরে দুয়েকটি বাদে সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স রয়েছে, যা আশঙ্কার ব্যাপার। আগেও অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ছিলে; কিন্তু কোভিডের সময় সেটি অনেক বেড়েছে। আগামী কয়েক বছর পর অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।'
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে আসা এক প্রেসক্রিপশনের দেখা গেছে, রাজধানীর একটি প্রাইভেট ল্যাবে গত মাসে ৭৭ বছর বয়সী এক রোগীর 'অ্যান্টিবায়োটিক সেন্সিটিভি ইন কালচার' পরীক্ষা করে দেখা গেছে, শুধু কলিস্টিন সেন্সেটিভ, বাকি ১২টি অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স। ওই রোগী এখন জীবন বাঁচাতে লড়ছেন।
ডা. তুষার মাহমুদ বলেন, 'আমরা জানি কোভিড ভাইরাল ইনফেকশন এবং ইনফেকটেড হওয়ার প্রথম তিনদিনে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই। তারপরও ৯৯% ক্ষেত্রে এমন হয়েছে, কোভিড পজিটিভ কিন্তু কোনো উপসর্গ নেই- এমন রোগীও অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছেন।'
'সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভ্যাকসিন নিয়ে এমনসব কথা হচ্ছে, তার ফলে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ভ্যাকসিন নিতে চাচ্ছেন না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাওয়া প্রেসক্রিপশনে দেখা যায়, সেটাতে হাইঅ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া আছে; আর, কোন যাচাই ছাড়াই সবাই তা খাচ্ছেন। বাংলাদেশ সম্ভবত পৃথিবীর দুয়েকটি দেশের মধ্যে একটি, যেখানে প্রকাশ্যে একটি প্রেসক্রিপশন সার্কুলেট হয়েছে, যেখানে অ্যান্টিবায়োটিক ছিল। পৃথিবীর কোনো দেশে অ্যান্টিবায়োটিক ওভার দ্য কাউন্টার পাওয়া যায় না।'
তিনি আরও বলেন, "কোভিড পজিটিভ মানে একেকজনের একেক রকম চিকিৎসা লাগে। কিন্তু আমাদের দেশে একজন রোগী সুস্থ্য হওয়ার পর তার পরিচিতদের নিজের প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলছেন, 'আমি এটা খেয়ে সুস্থ্য হয়েছি, আপনিও খান!' এটাতেই বিপদ বেড়েছে।"
ব্যক্তি পর্যায়ের পাশাপাশি হাসপাতালগুলোতেও অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার বেড়েছে বলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির (এএসএম) একটি যৌথ গবেষণায় উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ড ও আইসিইউতে ভর্তি রোগীদের ওপর অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার দেখতে গত মে থেকে জুলাই মাসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটের ১০টি হাসপাতালের ভর্তি রোগীদের ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়।
'অ্যান্টিবায়োটিক ইউজেস অ্যান্ড অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স ইন টেরটিয়ারি কেয়ার হসপিটালস অব বাংলাদেশ' শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়, হাসপাতালগুলোর কোভিড ওয়ার্ড ও আইসিইউতে হরদম ব্যবহার করা শীর্ষ ১০ অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে রয়েছে- সেফট্রায়াক্সন, মেট্রোনিডাজোল, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, ফ্লুক্লক্সাসিলিন, মেরোপেনেম, সেফিক্সিম, অ্যামোক্সিসিলিন+ক্লাভুলেনিক, সেফুরক্সিম ও মক্সিফ্লোক্সাসিন।
গবেষণায় বলা হয়, সরকারি ও বেসরকারি সব হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) বাদ দিলে, কোভিড ওয়ার্ড-সহ সব ক্ষেত্রের তৃতীয় প্রজন্মের সেফালোসপরিন- সেফট্রায়াক্সনের ব্যবহার খুবই কমন। সরকারি ও বেসরকারি- উভয় ধরনের হাসপাতালগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ১০টি অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে ৯টিই অভিন্ন। উভয় ধরনের হাসপাতালেই সেফট্রায়াক্সন ও মেট্রোনিডাজোল- এ দুটি অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে সবচেয়ে বেশি ব্যবহারের শীর্ষ দুইয়ের মধ্যে।
অন্যদিকে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বাদে অন্য সব সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে কোভিড আইসিইউ'র ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দেওয়া ওষুধের নাম মেরোপেনেম।
অন্যদিকে, কোভিড ওয়ার্ডে রেমডিসিভিরের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। গত বছর দেশে কোভিডের চিকিৎসায় রেমডিসিভির ছিলে আলোচিত ওষুধ। রেমডেসিভির ইনজেকশন হিসেবে পাঁচ থেকে ১০ দিনের মেয়াদে দেওয়ার প্রয়োজন হয়, এতে খরচ হয় ৫০ হাজার টাকার বেশি। ব্যয়বহুল এ ইনজেকশনটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১১.৭% এবং সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতালের ২২.৭% কোভিড ওয়ার্ডের রোগীদের দেওয়া হয়েছে।
চিকিৎসকেরা বলছেন, কোভিড-১৯ ভাইরাল ইনফেকশন; এর চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর নয়। শুধুমাত্র সেকেন্ডারি ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের আশঙ্কা থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু দেশের উপজেলা থেকে টারশিয়ালি লেভেল কোনো হাসপাতালেই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের প্রটোকল মেইনটেইন করা হয় না।
গ্লোবাল অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স পার্টনারশিপের (জিএআরপি) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীদের মধ্যে ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশনের মাত্রা ছিলে ১০-১২%; অথচ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে শতভাগ রোগীকে। এছাড়া গত দুই বছরে অ্যাজিথ্রোমাইজিন খাননি, বাংলাদেশে এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কোভিড যদি এক দুই বছর পর নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এর পরের মহামারি হবে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স।'
'তাহলে আমরা সার্জারি করতে পারব না, ক্যানসারের চিকিৎসা করতে পারব না এবং অনেক মানুষ সর্দি-কাশির মতো সাধারণ ইনফেকশনে মারা যাবে,' আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
অধ্যাপক সায়েদুর রহমান আরও বলেন, 'করোনাকালে সেলফ মেডিকেশন ও কোয়াকদের পরামর্শে বাসায় এজিথ্রোমাইসিন, ডক্সিসাইক্লিন ও অ্যামোক্সিসিলিনের ব্যবহার বেড়েছে। আর হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে মেরোপেনেম ও অ্যামোক্সিক্লেভের কনজামশন বেড়েছে। এর ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিসটেন্সের যে অবস্থায় আমরা তিন বা পাঁচ বছর পর পৌঁছাতাম, সেটাতে আমরা আগামী এক-দুই বছরের মধ্যে পৌঁছাব।'
অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোধে মানুষের সচেতনতা তৈরি করতে অ্যান্টিবায়োটিকের প্যাকেজিং লাল রঙ করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
'সারা দেশে প্রচার করতে হবে, লাল রঙের ওষুধটি ডাক্তারের পরামর্শে খেতে হবে। এর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক গাইডলাইন মানাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে। অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার রোধে চিকিৎসকদের সচেতন থাকতে হবে,' যোগ করেন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।