ময়মনসিংহে সুরক্ষা সরঞ্জাম নিশ্চিত না করেই শুরু হচ্ছে করোনা পরীক্ষা
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের ল্যাবে শুরু হচ্ছে করোনা ভাইরাস পরীক্ষা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ল্যাবটিতে দুই-একদিনের মধ্যেই ভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু হবে।
তবে সরেজমিনে দেখা গেছে, নমুনা সংগ্রহ থেকে ল্যাব টেস্ট পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই এখানে করোনা টেস্ট শুরু হতে যাচ্ছে। ঘাটতি রয়েছে সুরক্ষা সরঞ্জামেরও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ সুরক্ষা সরঞ্জাম ছাড়া এই ভাইরাসের পরীক্ষা চালানো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তবে মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, তারা নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
করোনা শনাক্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে ইতোমধ্যে নতুন যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাঠানো একটি টেকনিক্যাল টিম ল্যাবে থাকা আগের একটি বায়ো-সেফটি কেবিনেট ও পিসিআর সার্টিফাই করে গেছে।
এরইমধ্যে করোনা টেস্টের ২৪০টি কিট ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজকে দেওয়া হয়েছে। মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। প্রতি তিন ঘণ্টায় এই ল্যাবে ৯৪ জনের নমুনা পরীক্ষা করা যাবে।
সব প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, তখন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের নজরে পড়েছে কিছু অসঙ্গতি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে দেওয়া করোনা সম্পর্কিত নিরাপত্তার নিয়ম-কানুনে বলা হয়েছে, এই কাজে সংশ্লিষ্ট সকলের পিপিই প্রয়োজন। যেখানে থাকবে একটি ফেসশিল্ড, নির্দিষ্ট ডিজাইনের চশমা, এন ৯৫ মাস্ক, সুরক্ষা পোশাক, দুটি গ্লাভস এবং শু-কাভার।
এবার দেখা যাক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কতটুকু প্রস্তুত।
বলা হচ্ছে, ১০০টি পিপিই দেওয়া হয়েছে। অথচ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান ও ল্যাব ইন-চার্জ ডা. সালমা আহমেদ জানিয়েছেন, ফেসশিল্ড দেওয়া হয়নি, এন ৯৫ মাস্কের বদলে দেওয়া হয়েছে সাধারণ সার্জিক্যাল মাস্ক। জানা গেল, যে চশমা দেওয়া হয়েছে, সেটিও ল্যাবের কাজের জন্য নির্দিষ্ট ডিজাইনের নয়।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. আলিমুল ইসলাম জানালেন, নমুনা সংগ্রহ থেকে শুরু করে ভাইরাস পরীক্ষার প্রতিটি ধাপ গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক। যে টেকনেশিয়ান নমুনা সংগ্রহ করবেন, তাকে পর্যাপ্ত সুরক্ষা মেনে চলতে হবে। পিপিই বলতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা বোঝাচ্ছে, তার প্রতিটি থাকতেই হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে গবেষণা কাজে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই অধ্যাপক আরও বলেন, নমুনা সংগ্রহ করতে হয় গলা ও নাক থেকে। টেকনেশিয়ানকে তাই রোগীর খুব কাছাকাছি যেতে হয়। সেই ব্যক্তির শরীরে যদি করোনা ভাইরাস থাকে, তাহলে টেকনিশিয়ানের পোশাক ও হাতের গ্লাভসে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়বে। তখন পরবর্তী জনের নমুনা সংগ্রহের জন্য গেলে সেই ব্যক্তিও আক্রান্ত হবেন। তাই প্রতিটি রোগীর নমুনা সংগ্রহের পর গ্লাভস ও পোশাক পরিবর্তন করতে হবে।
তিনি বলেন, এরমধ্যে যদি পোশাকের ওপরে আরও একটি ধ্বংসযোগ্য আবরণ পরা হয়, তাহলে মূল পোশাক পরিবর্তন না করলেও চলবে। তবে এন ৯৫ মাস্ক ও ফেসশিল্ড না থাকলে নমুনা সংগ্রহকারী নিজেই আক্রান্ত হবেন।
অধ্যাপক ড. আলিমুল ইসলাম আরও বলেন, নমুনা সংগ্রহের পর সেটি বহন করারও নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। যারা এটি বহন করে ল্যাবরেটরি পর্যন্ত যাবেন, সেই অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভারসহ প্রত্যেককে পিপিই পরতে হবে এবং পিপিই ব্যবহারের পর তা ধ্বংস করতে হবে। তা না হলে ভাইরাস ছড়াবে।
তিনি বলেন, এরপর নমুনা পরীক্ষা করার কাজটি যারা করবেন তাদেরও একইভাবে সুরক্ষা শৃঙ্খলা মানতে হবে। তাই বোঝাই যাচ্ছে, কেন সঠিক পিপিই'র পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকতেই হবে। তা না হলে কিট থাকলেও পরীক্ষা করা সম্ভব হবে না। এখানে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি জানান, শঙ্কা এখানেই কাটছে না। নমুনা পরীক্ষার জন্য বায়ো-সেফটি লেভেল থ্রি মানের ল্যাবরেটরি প্রয়োজন। তবে ঢাকার বাইরে এ ধরনের ল্যাব নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন বলেছেন, সুরক্ষা নিশ্চিত না করে এই পরীক্ষার সঙ্গে যারা জড়িত থাকবেন, তারাই আগে আক্রান্ত হবেন। চিকিৎসক, ল্যাব টেকনেশিয়ানরাই যদি আক্রান্ত হন, তাহলে পরবর্তী সময়ে কাজ করার লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে নজরে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. চিত্তরঞ্জন দেবনাথ এসব ঘাটতির বিষয়ে সরাসরি কোনো উত্তর না দিয়ে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের জন্য একটি যুদ্ধক্ষেত্র। আর এই যুদ্ধের অগ্রবর্তী সৈনিক হলেন ডাক্তার, নার্স, ল্যাব টেকনেশিয়ানরা। তাদের সুরক্ষা দেওয়া আমাদের কর্তব্য।
এ বিষয়ে টেলিফোনে ময়মনসিংহ জেলা সিভিল সার্জন এবিএম মসিউল আলম বলেন, পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। কোথাও কোনো সমস্যা দেখছি না।
ঘাটতিগুলোর বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি তো ল্যাবে কাজ করব না! যারা কাজ করবে, তাদের সঙ্গে কথা বলুন!