যে ৩ কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে যানজট
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ২১টি জেলার সঙ্গে রাজধানীতে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট। ছোট-বড় মিলে দৈনিক প্রায় ৫ হাজার যানবাহন পারাপার হয় ব্যস্ততম এই নৌরুট দিয়ে।
প্রয়োজনের তুলনায় বাড়তি যানবাহন কিংবা যেকোন উৎসব বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই নৌরুটের উভয় ফেরিঘাট এলাকায় বাড়তে শুরু করে ভোগান্তি। যাত্রীদের কষ্ট লাঘবে বাস, ছোট গাড়ি ও জরুরী পণ্যবাহী যানবাহন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নৌরুট পারাপার করে কর্তৃপক্ষ।
এতে করে দীর্ঘ ভোগান্তির কবলে পড়েন সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক চালক ও শ্রমিকেরা। আধ ঘন্টার নৌরুট পারাপারের জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয় ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ও পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকায়। এতে করে শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন ট্রাক চালকেরা।
তিন কারণে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট এলাকায় ভোগান্তি আর যানজট হয় বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নৌরুটের ফেরি স্বল্পতা। এছাড়াও যে ফেরিগুলো নৌরুটে চলছে তা খুবই পুরাতন। পাশাপাশি পদ্মার প্রচণ্ড স্রোত তো রয়েছেই।
এসব কারণে নৌরুটে পারাপার হতে আসা যানবাহন চালক, শ্রমিক এবং যাত্রীদেরকে ভোগান্তি পোহাতে হয় ঘন্টার পর ঘন্টা। ফেরিঘাট এলাকার ভোগান্তি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হলেও উদাসীন ঘাট কর্তৃপক্ষ।
ফেরিঘাট এলাকার ভোগান্তি লাঘবে যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেছেন সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক ও বাস চালকেরা। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই ভোগান্তি থেকে স্থায়ীভাবে মুক্তির দাবি জানান তারা।
১. নৌরুটের ফেরি স্বল্পতা
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ১০টি বড় এবং মাঝারি ও ছোট মিলে ৮টি ফেরি রয়েছে। উভয় ফেরিঘাট এলাকা মিলে দৈনিক প্রায় ৫ হাজার যানবাহন পারাপার করা সম্ভব এই ফেরি দিয়ে। তবে এর চেয়ে বেশি যানবাহন নৌরুট পারাপার হতে আসলেই শুরু হয় ভোগান্তি।
বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে সম্প্রতি ফেরি চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় বড় যানবাহনগুলো আসছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে। এর ফলে ঘাট এলাকায় যানজট থাকছে নিয়মিতভাবে। নৌরুট পারাপারের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে হাজারের উপরে সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক।
এছাড়াও যেকোন উৎসব বা কোন রকমের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ভোগান্তি বাড়তে শুরু করে। বাস, ব্যক্তিগত ছোট গাড়ি ও জরুরী পণ্যবাহী ট্রাক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নৌরুট পারাপার করায় বিপাকে পড়েন সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক চালকেরা।
ফেরিঘাট এলাকার ভোগান্তি লাঘব করতে কমপক্ষে দুটি বড় ফেরি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে স্থায়ীভাবে সংযুক্ত করা উচিত বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।
২. লক্কর-ঝক্কর ফেরি
পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে যে ফেরিগুলো চলমান রয়েছে তা কয়েক যুগের পুরাতন। ফেরিগুলোতে সংস্কার ও নতুন ফেরি সংযুক্ত করা খুবই প্রয়োজন। তবে অজ্ঞাতকারণে নতুন করে কোন বড় ফেরি ঘাট এলাকায় সংযুক্ত করছে না বিআইডব্লিউটিসি।
নৌরুটে চলাচলরত ফেরিগুলো অনেক পুরাতন হয়ে যাওয়ায় সেগুলোর ইঞ্জিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি খুবই দুর্বল। যে কারণে কিছু সময় চলার পরে বিকল হয়ে যায়। পাটুরিয়া ফেরিঘাটে বিকল ফেরি মেরামতের জন্য 'মধুমতি' নামে একটি ভাসমান মেরামত কারখানা রয়েছে।
নৌরুটের হাজার হাজার যানবাহন পারাপারের জন্য ভরসা এই লক্কর-ঝক্কর ফেরিগুলো। প্রায়ই একসঙ্গে তিন থেকে চারটি ফেরি বিকল হয়ে মেরামত কারখানায় পড়ে থাকে। যে কারণে নৌরুটে পারাপার হতে আসা যানবাহন চালক ও যাত্রীরা নিয়মিতভাবে ভোগান্তির শিকার হন। এই ফেরিগুলোর বদলে নতুন করে ফেরি সংযুক্ত করার দাবি ঘাট সংশ্লিষ্টদের।
৩. পদ্মার স্রোত
বর্ষাকালে পদ্মা নদীতে প্রবল স্রোত থাকে। সাধারণ সময়ে নৌরুট পারাপারে সময় লাগে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট। আর ভরা বর্ষায় নদী পারাপারে সময় লাগে প্রায় এক ঘন্টা। অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ফেরি চলাচলে দ্বিগুণ সময় লেগে যাওয়ায় কমে আসে ফেরির ট্রিপ।
যে কারণে ঘাট এলাকায় বাড়তে শুরু করে যানজট। নদীতে প্রচণ্ড স্রোত থাকা সাধারণ ও নিয়মিত একটি বিষয়। যে কারণে এই বিষয়টি মাথায় রেখে আধুনিক ফেরি সংযুক্ত করার দাবি ঘাট কর্তৃপক্ষের।
বিআইডব্লিউটিসি (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন) সরকারের লাভজনক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। তবুও এই প্রতিষ্ঠানের প্রতি যথাযথ দৃষ্টির অভাব সংশ্লিষ্টদের। অল্প কিছু সমস্যার সমাধান করা হলে সরকারের এই প্রতিষ্ঠান আরও লাভজনক হবে বলে দাবি ঘাট কর্তৃপক্ষের।
গতকাল সকালে ঘাটের বিষয়ে জানতে চাইলে মাগুড়া জেলার ট্রাক চালক শামিম মিয়া বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে নিয়মিত পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে চলাচল করেন তিনি। মাগুড়া থেকে চট্টগ্রাম বা ময়মনসিংহ ও গাজীপুর এলাকায় ট্রিপ দেন বেশি।
মাগুড়া থেকে ওইসব এলাকায় চলাচল করার চেয়ে অধিক ভোগান্তি হয় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের উভয় ফেরিঘাট এলাকায়। দিনের পর দিন ফেরি পারাপারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ঘাট এলাকায় একদিনে খাবারের পেছনে জনপ্রতি ব্যয় হয় প্রায় তিনশো টাকা।
দুই বা তিনদিন ট্রাক চালিয়ে যে টাকা আয় হয় তা ঘাট এলাকায় যানজট হলেই খরচ হয়ে যায়। বাড়তি এই খরচের টাকা মহাজনেরা দেন না। যে কারণে ঘাট এলাকার ভোগান্তি লাঘবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি কামনা করেন তিনি।
ফারুক হোসেন নামে ধামরাই এলাকার এক ট্রাক চালক বলেন, ধামরাইয়ের একটি কারখানা থেকে নিয়মিতভাবে পণ্য নিয়ে বেনাপোল এলাকায় যাতায়াত করেন তিনি। ঘাট এলাকায় যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ থাকলে মহাসড়কের বিভিন্ন এলাকা আটকে রাখে পুলিশেরা।
যত্রতত্র পড়তে হয়ে ভোগান্তিতে। ঘাট এলাকায় অবহেলিত ট্রাক চালকেরা। অথচ ট্রাকের মহাজন এবং চালক-শ্রমিকদের চেয়ে বেশি মুনাফা পায় ঘাট কর্তৃপক্ষ। এরপরও এতো উদাসীনতার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব বলে মনে করেন তিনি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিটিসি আরিচা কার্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন রাসেল বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে ছোট-বড় মিলে মোট ১৮টি ফেরি যাত্রী ও যানবাহন চলাচল করছে। স্বাভাবিক সময়ে এই ফেরিগুলো দিয়ে দৈনিক প্রায় ৫ হাজার যানবাহন নৌরুটে পারাপার করা সম্ভব।
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুট পারাপার হতে ২৫ থেকে ৩০ মিনিট সময় লাগে। কিন্তু এখন নদীতে প্রচণ্ড স্রোত থাকায় সময় লাগছে প্রায় এক ঘন্টা। এতে করে ফেরির ট্রিপ নেমে এসেছে অর্ধেকে। যে কারণে ঘাট এলাকায় অপেক্ষামাণ যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত।
বিআইডব্লিটিসি আরিচা কার্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক সালাম হোসেন বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরিগুলো বেশ পুরাতন। আর দিন-রাত ২৪ ঘন্টাই সচল থাকে ফেরি সার্ভিস। যে কারণে ফেরিগুলো প্রায়ই বিকল হয়ে পড়ে। প্রায় প্রতিটি ফেরিই মাসে কমপক্ষে দু-তিন বার মেরামত করা প্রয়োজন হয়। আবার কোন কোনটি মাসে কমপক্ষে ৫/৭ বার মেরামত কারখানায় যায় আসে। যে কারণে নৌরুট পারাপারে ভোগান্তি বেশি হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এলাকার বাণিজ্য বিভাগের ব্যবস্থাপক জামাল উদ্দিন বলেন, ঘাট এলাকায় বাড়তি যানবাহনের চাপ থাকলে বাস ও ছোট গাড়ি নৌরুট পারাপার করা হয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। এতে করে সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাকের অপেক্ষামাণ সারি বাড়তে থাকে। ঘাট এলাকায় রাতে বাসের সংখ্যা কমে আসলে সিরিয়াল অনুযায়ী আটকে থাকা ট্রাকগুলো নৌরুট পারাপার করা হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মহাসড়কে ট্রাক আটকে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে শিবালয় থানার ওসি ফিরোজ কবির বলেন, পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকার দুইটি ট্রাক টার্নালের ধারণ ক্ষমতা ৪০০। এর চেয়ে ঘাটমুখী ট্রাকের চাপ বেশি থাকলে ঘাটের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ট্রাকগুলো মহাসড়ক ও উথুলী সংযোগ সড়কে আটকে রাখা হয়।
ঘাটের পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে আটকে রাখা ট্রাক থেকে স্বল্পসংখ্যক ট্রাক দফায় দফায় ঘাট এলাকায় পাঠানো হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নদীতে স্রোতের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ফেরিমাস্টার বলেন, নদীতে প্রচন্ড স্রোত থাকার কারণে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ উজানে গিয়ে এরপর ভাটিতে যেতে হয়। যে কারণে দ্বিগুণ সময় ব্যয় হয়। ফেরির ইঞ্জিন ক্ষমতা কম থাকায় স্রোতের বিপরীতে চলতে বেশ বেগ পোহাতে হয় বলে মন্তব্য করেন তিনি।
পাটুরিয়া ফেরিঘাট এলাকার ভাসমান মেরামত কারখানা মধুমতির নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল মান্নান বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে যে ফেরিগুলো চলছে তার মধ্যে থেকে প্রতিদিনই ২/৩টি করে ফেরি মেরামতের জন্য আসে। কখনো আবার ৪/৫টি ফেরি মেরামত কারখানায় জমে যায়। পর্যাপ্ত জনবল থাকায় দ্রুত মেরামত করে দেওয়া যায়।
তবে বড় ধরনের কাজ থাকলে সেগুলোর মেরামতে দুই-তিন দিন বা এর চেয়েও বেশি সময় লাগে। ফেরিগুলোর গিয়ার সমস্যা, সেল্ফ সমস্যা, পুলার এবং র্যাম সমস্যার কাজ বেশি করতে হয় বলে মন্তব্য করেন এই প্রকৌশলী।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কপোরেশনের আরিচা কার্যালয়ে ডিজিএম জিল্লুর রহমান বলেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরিগুলো বেশ পুরাতন। যে কারণে প্রায়ই বিকল হয়ে যায়। এছাড়া নৌরুটে ফেরি সংকটও রয়েছে।
আবার যানবাহন নিয়ে নদী পারাপার হতে ফেরিগুলোকে এখন সময় দিতে হচ্ছে আগের চেয়ে দ্বিগুণ। ঘাট এলাকায় রয়েছে বাড়তি যানবাহনের চাপ। এতে করে নৌরুটের উভয় ফেরিঘাট এলাকায় ভোগান্তি বাড়ছে।
স্থায়ীভাবে এই ভোগান্তি কমাতে চাইলে নৌরুটে নতুন করে কমপক্ষে দুইটি বড় ফেরি সংযুক্ত করা প্রয়োজন। বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিতভাবে জানানোর পরও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। কাজেই এই ফেরিগুলো দিয়েই এখন সার্ভিস দেওয়া ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।