লকডাউনের পর প্রথম দুই দিবসে চাঙা ফুলের বাজার
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে নাকাল ফুলের রাজধানীখ্যাত যশোরের গদখালির চাষীরা। গত বছর তারা কোন ব্যবসা করতে পারেনি। তবে বুদ্ধিজীবী দিবস ও ১৬ ডিসেম্বরকে ঘিরে ফুলের ব্যবসা কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। শীতে আবার করোনার প্রকোপ বৃদ্ধিতে ফুল চাষীদের মধ্যে আবারও আতংক ফিরে এসেছে।
ফুল চাষীদের ফুলের চাহিদা বাড়ে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে। কিন্তু ভাইরাসের প্রভাবে গত ফেরুয়ারি ও মার্চ মাসে কোন ব্যবসা করতে পারেনি ফুল চাষীরা। তার উপর করোনার প্রভাবের সঙ্গে এসে যোগ হয় ঘূর্ণিঝড় আম্পান। তখন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফুল চাষের ওপর নির্ভরশীল এলাকার হাজার হাজার মানুষ। এমন ঘটনাও ঘটেছে বিক্রি না হওয়ায় গরু-ছাগল দিয়ে অনেক চাষী ক্ষেতের ফুল খাইয়েছে।
দেশের মধ্যে বাণ্যিজিকভাবে যশোর জেলার গদখালীতে ফুল চাষ শুরু করা হয় আশির দশকে। দেশে ফুলের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারও এখানে। ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা গদখালিতেই আসেন ফুল কেনার জন্য । এখানে ফুল উৎপাদন ও কেনাবেচায় শত শত কোটি টাকার লেনদেন হয় বছরে।
যশোর শহর থেকে পশ্চিমের উপজেলা ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার ৭৫টি গ্রামের প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হয় হরেক রকমের ফুল। ঝিকরগাছা ও শার্শা থানার গ্রামগুলোর রাস্তার দুইপাশে দিগন্ত বিস্তৃত জমিতে লাল, নীল, হলুদ, বেগুনি আর সাদা রঙের ফুলের সমাহার দেখা যায়। প্রতিদিন ঝিকরগাছা উপজেলার পানিসারার শত শত ফুলচাষী ফুল নিয়ে আসেন গদখালীর বাজারে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছোট-বড় পাইকাররা। বিভিন্ন হাতবদল হয়ে পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার মাধ্যমে ফুল ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও।
ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়নের পানিসারা, হাড়িয়া, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া, মাটিকুমড়া, বাইসা, কাউবা, ফুলিয়া আর শার্শার নাভারন, উলাশি, গদখালী ও শ্যামলাগাছি গ্রামের প্রায় প্রতিটি মাঠ এখনও ভরা ফুলে। শত শত হেক্টর জমি নিয়ে গাঁদা, গোলাপ, গাডিওলাস, রজনীগন্ধা, জারবেরা, কসমস, ডেইজ জিপসি, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকাসহ বিভিন্ন ধরণের ফুলের চাষ রয়েছে এখানে।
করোনা পরিস্থিতি আসার আগে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠতো গদখালীর ফুলের বাজার। কিন্তু করোনার লকডাউনের সময় ফুলের বাজার প্রায় ক্রেতাশূণ্য হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির (বিএফএস) সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, 'এবার ঝিকরগাছা ও শার্শা উপজেলায় সাড়ে ছয় হাজার হেক্টর জমিতে ফুলের আবাদ করেছিলেন। করোনার কারণে কেউ তেমন ব্যবসা করতে পারেনি। গদখালি অঞ্চলে ৫ হাজার কৃষকের মধ্যে ৫৫ জন সরকারের প্রণোদনা ঋণ পেয়েছে। বাকিরা এনজিও ঋণ ও অনেকে জমি বিক্রি করে সংসার চালিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, 'করোনাভাইরাস ও ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ফুল সেক্টরের যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়। সেই অবস্থা থেকে এবারের ১৪ ও ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে অন্তত ৫০ লাখ টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এ সময়ে প্রায় ২ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়।
পানিসারা গ্রামের আবদুল রহিম জানান, প্রতি একর জারবেরা ফুল চাষ করতে ৩৬ লাখ টাকা খরচ হয়। রজনীগন্ধা চাষে একর প্রতি খরচ আড়াই লাখ টাকা, গোলাপ সাড়ে চার লাখ টাকা, গ্লাডিওলাস চার লাখ টাকা, আর গাঁদা চাষে দুই লাখ ত্রিশ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে থাকে।
লকডাউন ওঠে যাওয়ার পর থেকে ফুল বেচাকেনা আবার শুরু হয়। এখনও আগের পর্যায়ে বাজার যায়নি, তবে ফুল যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। এই দুই দিবস উপলক্ষে ভালো বিক্রি হয়েছে। এতে কিছুটা ক্ষতি পুষবে কৃষকদের।
গদখালী হাড়িয়া গ্রামের ফুল চাষী রহমত গাজী বলেন, 'আড়াই বিঘা জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ করেছিলাম। প্রতিপিস ৪ টাকা করে বিক্রি করেছি। এতে সামান্য লাভ হয়েছে।
ঝিকরগাছার পটুয়াপাড়া এলাকার কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, 'করোনাভাইরাসে ফুল বিক্রি না হওয়াতে দেনাগ্রস্থ হয়ে পড়ি। দুই দিবসে ভালো বিক্রি হল। রজনীগন্ধা একশ পিস ৮শ টাকা, জারবেরা ১২ টাকা, গাঁধা ফুল ৫শ টাকা প্রতি হাজার, গ্লাডিওলাস এক হাজার থেকে ১২ টাকা বিক্রি দরে হয়েছে।
যশোর ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মাসুম হোসেন পলাশ জানান, 'উপজেলার গদখালীতে এবার সাড় ছয় হাজার হেক্টর জমি ফুলের আবাদ করা হয়েছে। মহামারি-ঘূর্ণিঝড়ে ফুল চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। তবে এখন ফুল বেচাকেনা আবার শুরু হয়েছে। চলতি মাসে ভালো ফুল বিক্রি হয়েছে বলে জেনেছি।
যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের উপপরিচারক বাদল চন্দ্র জানান, করোনায় ফুল চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও চলতি মাসে তাদের ভালো ফুল বিক্রি হয়েছে। এরই মধ্যে ফুল চাষের সঙ্গে জড়িত ৩শ জন চাষীর মাঝে বিনামূল্যে আউসের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ ৫০০ কৃষকের মাঝে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছি। যারা প্রকৃত ফুলচাষী তাদের চিহ্নিত করে আরও সহযোগিতা করার চিন্তাভাবনা আমাদের আছে।'