৪০ বছর আগে এক কৃষকের হাতে রজনীগন্ধা দিয়ে শুরু, আজ কোটি টাকার ফুলের বাজার গদখালি
যশোর জেলা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে গদখালি গ্রাম, যে গ্রামকে মানুষ চেনে ফুলের জন্য। বাংলাদেশের ফুলের রাজধানী হিসেবে খ্যাত এই গদখালি। ফুলকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে গদখালি অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকা। ফুলের সাথে এ অঞ্চলের চাষিদের এক অদ্ভুত মিতালি। গদখালিতে শুধু ফুলেরা হাসে না, তারা হাসি ফোটায় ফুলচাষিদের মুখেও। প্রতিদিন ভোরবেলা গদখালি বাজার জুড়ে বসে বৈচিত্র্যময় ফুলের মেলা। দেশের বিভিন্ন এলাকার ফুল ব্যবসায়ীরা গদখালি বাজারে আসেন ফুলের খোঁজে। শীতকালের শিশিরমাখা কুয়াশায় গোলাপ, রজনীগন্ধা আর গ্লাডিওলাসের রূপ ও গন্ধে ভরে ওঠে সমস্ত ক্রেতা-বিক্রতার মন। অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে তাদের মুখে। বাস, ট্রাক, পিকআপে করে হাজারো ফুল দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছায়। আর এভাবেই গদখালির নানা রঙের বাহারি ফুলের সুবাস পৌঁছায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ফুলপ্রেমীদের কাছে।
গদখালিতে বাংলাদেশের অন্যান্য কৃষি জমির মতন ধান, পাটসহ নানা ফসল চাষ করা হতো। শের আলি সর্দার নামের একজন কৃষক সর্বপ্রথম গদখালিতে ফুল চাষের উদ্যোগ নেন। শের আলির বাবার ছিল নার্সারির ব্যবসা। সেই নার্সারিতে চারা কিনতে আসা এক ভারতীয় ভদ্রলোকের কাছ থেকে শের আলি জানতে পারেন, পশ্চিমবঙ্গে রজনীগন্ধাসহ বিভিন্ন ফুলের চাষ এবং ভালো উৎপাদন হয়। তখন থেকেই শের আলি সর্দার ভাবতে শুরু করেন ফুল চাষের ব্যাপারটি নিয়ে। ১৯৮২ সালের দিকে তিনি পরীক্ষামূলকভাবে এক বিঘা জমিতে রজনীগন্ধা ফুল চাষ করেন এবং সফলতার মুখ দেখেন। তার সফলতা দেখে আরও অনেক কৃষক ফুলচাষের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। এভাবেই গদখালি অঞ্চলজুড়ে ফুল চাষের শুরু হয়।
কথা বললাম চাওরা গ্রামের একজন ফুলচাষি মোহাম্মদ কামাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ১০ বছর ধরে গাঁদা, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস ও গোলাপ ফুল চাষ করেন তিনি। বিগত ৫ বছর ধরে গোলাপ চাষের দিকেই বেশি ঝুঁকেছেন। ফুল চাষের কাজে চুক্তি ভিত্তিতে ২/৫ জন লোক নেন। বাগানে প্রতিদিন ২০০–৩০০ গোলাপ ফোটে। প্রচণ্ড শীতে একদিন পর একদিন গোলাপ কাটলে ফলন বেশি পাওয়া যায়। তিনি বলেন, গদখালি বাজারে গিয়ে ফুল বিক্রি করতে হয় তাকে। এক্ষেত্রে যেসব ফুল ব্যবসায়ী গদখালি বাজার থেকে ফুল দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান তারাই বেশি লাভের মুখ দেখেন। গদখালি স্টেশনটি বহুদিন ধরে বন্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। স্টেশন চালু করা গেলে অনেক ফুলচাষি নিজেদের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ফুল সরবরাহ করতে পারতেন।
শুধু ফুল ব্যবসার সাথে জড়িয়ে থাকা ব্যবসায়ী নয়, বরং দেশের সৌন্দর্যপিপাসু বহু মানুষ অতিথি পাখির মতন বেড়াতে আসেন গদখালি ফুল বাজারে। গদখালি এলাকাটি বিগত বছরগুলোতে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। বিশেষ করে শীতের দিনে শুক্র-শনিবার গদখালি ও পানিসারা ফুল বাজারে পা রাখা দায়। পর্যটকদের প্রচণ্ড ভিড়। বেলা বাড়লে বাড়তে থাকে ভিড়ও।
গোলাপ ফুলচাষি ফিরোজ আহমেদ শুভ জানালেন, ১ বিঘা ২ কাঠা জমিতে একবছর ধরে পেশাগতভাবে ফুল চাষ করেন তিনি। গোলাপ চাষ মোটামুটি লাভজনক বলে জানালেন এই চাষি। মনিরামপুর কোয়াদা বাজারের নার্সারি থেকে কিনে নিয়ে আসেন ফুলের বীজ। গোলাপ ফুল পাইকারি দরে গদখালি বাজারে গিয়ে বিক্রি করেন। গোলাপ ফুল চাষের বিশেষত্ব হচ্ছে সারাবছর ধরে ফোটে। তবে শীতের দিকে বিক্রি বাড়ে, দামও তুলনামূলকভাবে বেশি পাওয়া যায়। তার জমিতে দুজন শ্রমিক কাজ করে চুক্তি ভিত্তিতে।
করোনাকালীন সময়ে ফুল ব্যবসার যে ব্যাপক ক্ষতি তা বিগত কয়েক বছরে আস্তে আস্তে কাটিয়ে উঠেছেন ফুলচাষিরা। সাকিব ফুল ঘরের মালিক ফুল ব্যবসায়ী মো. তারেকের ভাষায়, 'মানুষ তখনই ফুল কেনে যখন সে শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে ভালো অবস্থায় থাকে। সুতরাং ফুল ব্যবসা নির্ভর করে দেশের মানুষের সামগ্রিক অবস্থার ওপর।' করোনাকালের ক্ষতিকে সামাল দিয়ে উঠেছেন তিনি। ফুল ব্যবসায় প্রতিবারই শীতকালে বিক্রি বাড়ে। এবারও বেড়েছে। পানিসারায় তার রয়েছে ২টি ফুলের আড়ৎ। প্রতিদিন ১ লাখ থেকে ২ লাখ টাকার ফুল বিক্রি করছেন তিনি। বিশেষ বিশেষ দিনে বিক্রি বেড়ে যায়।
পানিসারা ফুল বাজারে ঢুকে অনেকগুলো সুসজ্জিত ফুলের দোকান চোখে পড়ল। এর মধ্যে দেখতে পেলাম একজন বয়স্ক ফুল বিক্রেতাকে, যার নেই কোনো দোকান। রাস্তাতে বসেই গোলাপের তোড়া নিয়ে ফুল বিক্রি করছেন মো. জয়নাল আবেদিন। বললেন, দুবছর ধরে ফুল বিক্রি করেন। প্রতিটি গোলাপ ৬–৭ টাকা ধরে বিক্রি হয়। ক্রেতাদের ভিড়ের ওপর কেনাবেচা নির্ভর করে। তবে ফুল বিক্রি করে মোটামুটি দিন চলে যায় তার। অভাবের মুখ দেখতে হয় না।
ঝিকরগাছা উপজেলা কৃষি অফিসের দেওয়া তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে সর্বমোট ৬২০ হেক্টর জমিতে ১০ রকমের ফুলের চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে শতাধিক হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে গোলাপর, গাঁদা, রজনীগন্ধা ও গ্লাডিওলাস। চাষকৃত অন্যান্য ফুলের মধ্যে রয়েছে জারবেরা, রথস্টিক, চন্দ্রমল্লিকা, জিপসী, টিউলিপ ও লিলিয়াম। আর পাঁচ হাজারের বেশি চাষির ফুল বিক্রয়ের পরিমাণ প্রায় ৪২ কোটি টাকা।
উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নয়নানন্দন পাল জানান, গদখালি ফুলবাজারের নামটাই সবার জানা। কিন্তু ফুল চাষ হয় গদখালি, নাভারণ, পানিসারা, হাড়িয়া, নীলকন্ঠ নগর, চাওরা, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, চাঁদপুর, বাইশা, পাটুয়াপাড়া, নারানজালিসহ প্রায় ৫০–৫৫টি গ্রামে। ফুলের আবাদ সবথেকে বেশি পানিসারা গ্রামে। ইউএসএইড-এর অর্থায়নে একটি প্রকল্পের আওতায় উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে কৃষকদেরকে ফুলের প্রসেসিং শেড করে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটি যশোর জেলার সভাপতি আব্দুর রহিম জানান, সোসাইটির অধীনে ফুলচাষিদের আধুনিক ফুল চাষ, নানা উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানো হয়। রজনীগন্ধা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস ফুলের মান রপ্তানিযোগ্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'কিন্তু ফুল রপ্তানির জন্য যে রপ্তানি কোড প্রয়োজন তা নেই।' এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্লাস্টিকের ফুলের ব্যবহার কমিয়ে আনলে দেশীয় বাজারেও ফুলের প্রসার বাড়বে বলে মনে করেন তিনি।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, পানিসারায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্যোগে ফুলের কোল্ড স্টোরেজের কাজ প্রাথমিকভাবে শেষ হয়েছে। কিছু আইনি জটিলতা থাকায় তা এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। তবে কৃষকরা এটি ব্যবহার করবার অনুমতি পেয়েছেন। কোল্ড স্টোরেজ তৈরির পর ফুলের বীজ সংরক্ষণ সহজতর হয়েছে। গদখালি স্টেশন চালুর পাশাপাশি কুলিং ভ্যানের ব্যবস্থা না করা হলে ফুল তাজা অবস্থায় পৌঁছানো কষ্টকর হয়ে যাবে বলে জানালেন এই কর্মকর্তা।
গদখালি স্টেশন চালুর দাবিটি গদখালি ও আশপাশের অঞ্চলের প্রতিটি ফুলচাষি ও ব্যবসায়ীর প্রাণের দাবি। স্টেশনটি ফুলক্ষেত থেকে কাছাকাছি হওয়ায় ফুল আনা নেয়ার যেমন সুবিধা, তেমনি বাঁচবে পরিবহন খরচ। যেসব নবীন ফুল ব্যবসায়ী উত্তরবঙ্গের জেলাগুলো থেকে অতিরিক্ত খরচের কথা ভেবে গদখালির ফুল আনতে পারেন না, এটি তাদেরকেও এনে দেবে নতুন সুযোগ। বাংলাদেশের ফুল ব্যবসার ৬৫ ভাগ ফুলের সরবরাহ হয় গদখালি থেকে। স্টেশনটি চালু হলে এ হার আরও বাড়বে।