সুন্দরবনে ২০ বছরে ২৪ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগে ২০ বছরে ২৪ বার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকান্ডের কারণ অনুসন্ধান ও ভবিষ্যতে অগ্নিকান্ড এড়াতে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে সুপারিশ ১৫ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি। এসব কারণে বারবার অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন বন সংলগ্ন এলাকার সচেতন মহল ও পরিবেশবিদরা।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুন্দরবনে ২০০২ সালে কটকা এলাকায় একবার, নাংলী ও মান্দারবাড়িয়া এলাকায় দুই বার, ২০০৫ সালে পচাকোরালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল দুইবার, ২০০৬ সালে তেরাবেকায়, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকরালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোরালিয়া, নাংলি ও ডুমুরিয়া এলাকায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলশাখালী একবার, ২০১১ সালে নাংলিতে দুইবার, ২০১৪ সালে গুলশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলি, পচাকোরালিয়া ও তুলাতুলিতে তিনবার, ২০১৭ সালে মাদ্রাসা ছিলায় একবার এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর এলাকায় সোমবার (০৮ ফেব্রুয়ারিু) চার শতক বনভূমি পুড়ে যায়। বন বিভাগের হিসেব মতে ২৪ বারের অগ্নিকান্ডে ৭১ একর ৬৬ শতাংশ বনভূমির ক্ষতি হয়। যার আর্থিক মূল্য ১৮ লক্ষ ৫৫ হাজার ৫'শ ৩৩ টাকা।অগ্নিকান্ডের পরে কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও পরবর্তী সময়ে এ ধরণের ঘটনা এড়াতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে সুপারিশসহ রিপোর্টও পেশ করে। তবে সেসব থেকে যায় ফাইলবন্দী।
গুরুত্বপূর্ণ অগ্নিকান্ডের পরে গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টে আগুন লাগার কারণ হিসেবে মৌয়ালীদের ব্যবহৃত আগুনের কুন্ডলী, জেলেদের সিগারেট, দাবদাহ, অনাবৃষ্টি, খরা, বন অপরাধে সাজা প্রাপ্তদের প্রতিশোধ মূলক ব্যবস্থা, দুস্কৃতকারীদের দ্বারা বনের মধ্যে আগুন ধরানোকে দায়ী করা হয়। আগুনের স্থায়ীত্বের কারণ হিসেবে বিভিন্ন গাছের পাতার পুরু স্তরকেও দায়ী করেছেন তদন্ত কমিটি।
অগ্নিকান্ড এড়াতে বিভিন্ন সময় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে জোরালোভাবে তিনটি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে, সুন্দরবন সংলগ্ন লোকালয়ের সাথে মিশে যাওয়া নদী ও খাল খনন, অগ্নিকান্ড প্রবণ এলাকায় প্রতি ২ কিলোমিটার পরপর ওয়াচ টাওয়ার নির্মান করে নজরদারির ব্যবস্থা করা, চাঁদপাই রেঞ্জের ভোলা নদীর কোল ঘেঁষে বনের পাশদিয়ে কাঁটাতার অথবা নাইলনের রশির নেট দিয়ে বেড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা। কিন্তু এই তিনটির একটিও আজ পর্যন্ত বাস্তবায়ণ হয়নি। যার ফলে অবাধে বনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে মৌয়ালী, বাওয়ালী, বনজীবী ও স্থানীয়রা। বন সংলগ্ন এলাকার সচেতন মহল দাবি করছেন কিছু অসাধু বন কর্মকর্তাদের যোগসাজসে বনের মধ্যে মাছ ধরার জন্য বনের মধ্যে আগুন ধরানো হয়। সেখানেই পরবর্তীতে জাল পেতে মাশওয়ারা দিয়ে মাছ ধরেন জেলেরা। যার ফলে একের পর এক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে সুন্দরবনে।
শরণখোলাস্থ সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহবায়ক নজরুল ইসলাম আকন বলেন, পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে সুন্দরবন নজরদারিতে ব্যাঘাত ঘটে। আগুন থেকে সুন্দরবন মুক্ত রাখতে হলে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি বন সংলগ্ন এলাকায় সচেতনতা তৈরি করতে হবে। বনরক্ষীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ বিভিন্ন সময় উঠে আসে, সঠিক তদন্তপূর্বক তার ওপর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. শেখ ফরিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনায় বন বিভাগ যে ক্ষতির পরিমান উল্লেখ করেছে, তা সামান্য। আমি মনে করি, বনভূমি পুড়ে যে ক্ষতি হয়েছে তা কয়েকগুন। বনবিভাগ তাদের অভ্যন্তরীণ কমিটি দিয়ে তদন্ত করেছে। তাদের স্বার্থেই ক্ষতিপূরণ কম দেখানো হয়েছে। প্রত্যেকটি আগুনের ক্ষতিপূরণ সঠিক ভাবে নিরুপণ করা উচিত। সুন্দরবনকে সুরক্ষা করতে হলে লোকালয় সংলগ্ন নদী-খাল খনন ও কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া এখন সময়ের দাবি। এছাড়া বন অপরাধীদের দৌরাত্ম্য রোধ ও অসাধু বন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, আগুন লাগার বিষয়ে আমাদের তদন্ত কমিটির যে সুপারিশ রয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সুপারিশ বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যমে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছি। আশা করছি অচিরেই এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হবে। অবাধে সুন্দরবনে প্রবেশের দ্বার বন্ধ হবে। এছাড়া জনবল সংকটের বিষয়টিও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।