সৈকতের মেরিন ড্রাইভে সিনহা হত্যার এক বছর পার: করোনায় আটকে আছে বিচারকার্য
অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার এক বছর পূর্ণ হলো শনিবার (৩১ জুলাই)। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়ার শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন তিনি।
হত্যার পর সিনহার গাড়ি থেকে ইয়াবা, গাঁজা ও মদ উদ্ধারের কথা বলে পুলিশ। পুলিশের পক্ষ হতে দায়ের করা হয় একাধিক মামলাও। কিন্তু ঘটনার পরদিনই পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন 'রাওয়া' এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে। সোচ্চার হয় মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম।
বিচারবহির্ভূত এ হত্যার ঘটনায় জনগণও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। এতে উর্ধ্বতন মহলের নির্দেশে সিনহা হত্যা মামলা গুরুত্বের সঙ্গে দ্রুত তদন্ত ও অভিযোগপত্র দায়েরের মাধ্যমে এখন বিচারিক পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আটকে গেছে চলতি মাসে নির্ধারিত স্বাক্ষ্যগ্রহণ।
এদিকে, হত্যাকাণ্ডের এক বছর পরেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না তার মা-বোনেরা। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা নাসিমা আক্তার অনেকটা অসুস্থ। ঘরের প্রতিটি জায়গায় ছেলের স্মৃতি হাতড়ে বেড়ান তিনি। তবে ছেলের বিভিন্ন সময়ের মানসিক শক্তি যোগানো কথাগুলো লালন করে সময় পার করেন। মা আশাবাদী, দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হবে। মুঠোফোনে এমনটিই জানান সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার।
হত্যাকাণ্ডের পাঁচ দিনের মাথায় ৫ আগস্ট শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতকে প্রধান ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপকে দ্বিতীয় ও এসআই নন্দদুলাল রক্ষিতসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর: এসটি-৪৯৩/২০২১; জিআর মামলা নম্বর: ৭০৩/২০২০ ও টেকনাফ মডেল থানা মামলা নম্বর: ৯/২০২০)। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব-১৫।
এরপর মামলার আসামি ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় ৩ জন, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) ৩ সদস্য এবং প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরও ৭ জনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। গত ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আলোচিত এ মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসেন। আসামিদের মধ্যে ১২ জন নিজেদের দোষ স্বীকার করে আদালতের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে। শুধু ওসি প্রদীপ, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও সাগর দেব আদালতে জবানবন্দি দেননি।
এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চার মাসের বেশি সময় ধরে চলা তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ আলোচিত মামলাটির চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন র্যাব-১৫ -এর সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি 'পরিকল্পিত ঘটনা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) বিভিন্ন ধরনের আলামত ও ডিজিটাল কন্টেন্ট আমলে এনে চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলায় চার্জশিট দেন।
চার্জশিট থেকে জানা গেছে, গত বছরের ৭ জুলাই সিনহা মো. রাশেদ খান, শিপ্রা দেবনাথ, সিফাত ও রুফতি নীলিমা রিসোর্টে অবস্থান করেন। ইউটিউবে একটি ভিডিও চ্যানেল নিয়ে কাজ করার সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা হয়। সাধারণ মানুষ পুলিশের মাধ্যমে তাদের জিম্মি দশা, অত্যাচারের ঘটনা মেজর সিনহাকে জানায়। এসব জানতে পেরে সিনহা পীড়িত হন।
আরও জানা গেছে, কক্সবাজারের টেকনাফ ওসি প্রদীপের কথিত রাজ্য ছিল। মূলত তার স্বেচ্ছাচারিতা, আইন অমান্য করে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা এবং তার অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য সিনহা ও তার সঙ্গীরা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। ওসি প্রদীপ সরকারি অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করতেন এবং ইয়াবাকেন্দ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলেও অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
এসব বিষয়ে ওসি প্রদীপের কাছে জানতে ক্যামেরা ও ডিভাইসসহ সিনহা, শিপ্রা ও সিফাত থানায় যান। র্যাবের অভিযোগপত্রে বলা হয়, থানায় তাদের অনতিবিলম্বে টেকনাফ বা কক্সবাজার ছেড়ে যেতে বলা হয়। তা না হলে 'তোমাদের আমি ধ্বংস করে দেব' বলে হুমকি দেন প্রদীপ। ওসি প্রদীপের হুমকি উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাওয়ায় ষড়যন্ত্র করে মেজর সিনহাকে হত্যা করা হয়।
ঘটনার দিন সকাল থেকেই সিনহার গতিবিধি নজরে রাখা হয়। একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর 'বৃক্ষরোপণ' অনুষ্ঠান শেষে ওসি প্রদীপকে জানানো হয়, মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ প্রাইভেটকার নিয়ে টেকনাফের শামলাপুর পাহাড়ে গেছেন। এ সময় সোর্সের মাধ্যমে বাহারছড়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী সিনহার প্রতি নজর রাখতে থাকেন। শামলাপুর এপিবিএন পুলিশের চেকপোস্টে তল্লাশির নামে গাড়ি থেকে নামিয়ে মেজর সিনহাকে খুব কাছ থেকে চারটি গুলি করেন ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী।
এর কিছুক্ষণ পরেই প্রদীপ কুমার দাশ যখন ঘটনাস্থলে যান, তখনো মেজর সিনহা জীবিত ছিলেন। এ সময় ওসি প্রদীপ সিনহার 'মুখমণ্ডল ও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পায়ের জুতা দিয়ে আঘাত করে' বিকৃত করার চেষ্টা করেন। এর পরই সিনহার মৃত্যু হয়। পরে লোক দেখানোভাবে তাকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে নেওয়া হয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
মামলায় অভিযুক্ত ও কারাগারে আটক থাকা ১৫ আসামি হলেন বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, দেহরক্ষী রুবেল শর্মা, টেকনাফ থানার এসআই নন্দদুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাগর দেব, এপিবিএনের এসআই মো. শাহজাহান, কনস্টেবল মো. রাজীব ও মো. আবদুল্লাহ, পুলিশের মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মো. নিজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন।
কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, গত ২৭ জুন কক্সবাজারের জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল আসামিদের উপস্থিতিতে মামলাটির চার্জ গঠন করে ২৬, ২৭ ও ২৮ জুলাই একটানা তিনদিন বাদীসহ ১০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য করে আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার কারণে লকডাউনে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চললে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণসহ অন্যান্য আইনি কার্যক্রমও স্বাভাবিক নিয়মে চলবে। বিচারকাজ শুরুর অন্যান্য কাজ এগিয়ে রয়েছে।
সিনহার বোন শারমিন ফেরদৌসের করা মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা বলেন, 'করোনায় আদালতের স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বর্তমানে মামলার কার্যক্রম থেমে আছে। এ ছাড়া আর কোনো বাধা নেই। আদালত চালু হলে মামলার কার্যক্রম নিজস্ব গতিতে শুরু হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।'
উল্লেখ্য, সিনহা হত্যা ও তা ধামাচাপা দিতে নানা বিতর্ক ঘটনায় ইমেজ সংকটে পড়ে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। তা কাটাতে জেলার পুলিশ সুপার, কনস্টেবলসহ প্রায় ১৪০০ সদস্যকে কক্সবাজার থেকে একযোগে বদলি করা হয়। গঠিত হয় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (যুগ্মসচিব) মিজানুর রহমানের নেতৃত্বে ৪ সদস্য বিশিষ্ট উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি। এই কমিটি তদন্ত শেষে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশসহ তাদের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।