হাতিয়ায় শত কোটি টাকার চেউয়া শুঁটকি
নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার মেঘনা নদীতে এবার ধরা পড়েছে প্রচুর চেউয়া মাছ। আর চলতি মৌসুমে উপজেলার জাহাজমারা, নিঝুমদ্বীপ, বুড়িরচর ও সোনাদিয়া ইউনিয়নে উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৮হাজার ৫'শ টন চেউয়া শুঁটকি। যার বাজার মূল্য অন্তত শত কোটি টাকা। গত মৌসুমে যার উৎপাদন হয়েছিল মাত্র ১ হাজার টন। দেশে চেউয়া মাছের অর্ধেক চাহিদা মেটায় এ জনপদের মৎস্যজীবিরা। শুধু চেউয়া মাছ আর শুঁটকি নয়, বর্ষা মৌসুমে ইলিশের জন্যও বিখ্যাত হাতিয়ার বিভিন্ন ঘাট। এতকিছুর পরও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত হওয়ায় দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে স্থানীয় মৎস্যজীবিদের। তাদের দাবী যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হলে বর্তমানের চেয়ে আরও কয়েক গুণ বাড়বে তাদের শুঁটকির উৎপাদন।
যেভাবে তৈরি হয় চেউয়া শুঁটকি
নদী থেকে মাছ ধরার পর তার সঠিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে মাছ সহজেই পচে যায়। মাছ সংরক্ষণের প্রাচীন পদ্ধতি হলো আগে তা রোদে শুকানো। রোদে শুকিয়ে নিলে মাছ থেকে পানি ও বিভিন্ন অণুজীব, যা মাছ পচতে সহায়তা করে তা নষ্ট হয়ে যায়। পরে তা অন্তত ৩-৪দিন খোলা মাঠে বাতাস ও রোদে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে সহজ, কম খরচে শুঁটকি উৎপাদন করা যায়। তবে মাঝে মাঝে লবণেরও ব্যবহার করতে হয় শুঁটকিতে। আর এভাবেই হাতিয়া উপকূলে প্রতি মৌসুমে হাজার হাজার টন চেউয়া শুঁটকি উৎপাদিত হচ্ছে।
চেউয়া উৎপাদন কাজে জড়িতদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলাটির জঙ্গলিয়া ঘাট, মোহাম্মদপুর ঘাট, মুক্তারিয়া ঘাট, কাঁটাখালি ঘাট, কাদিরাঘাট ও রহমত বাজার ঘাটসহ বেশ কয়েকটি ঘাটে প্রতি মৌসুমে চেউয়া শুঁটি উৎপাদনের কাজ চলে। প্রতি বছরের বাংলা অগ্রহায়ণ মাস থেকে শুরু হওয়া এ চেউয়া মাছের মৌসুম চলে চৈত্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তাদের হাত ধরে দেশে অর্ধেক চেউয়া মাছের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এর বাইরে মাছ ও মুরগির খাদ্য (ফিড) উৎপাদনে ব্যবহৃত চেউয়া শুঁটকির বেশিরভাগই যায় এই দ্বীপ থেকে।
জেলেরা জানান, উপজেলার প্রায় ২০০একর জমির ওপর চলে এ চেউয়া শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। নদীতে চেউয়া মাছ ধরতে প্রায় ৩১০টি নৌকায় কাজ করেন অন্তত ৭হাজার ৭৫০জন জেলে। প্রতিটি নৌকায় ২জন মাঝি ও ২৫জন নাইয়া থাকে। এরপর মাছগুলো মাঠে এনে শুঁটকি তৈরির জন্য ছোট বড় বাছাই করে রোধে শুকানোর কাজে রয়েছেন বিভিন্ন বয়সের আরও ৪৫০জন শ্রমিক। নদী থেকে মাছ তোলার পর রৌদে শুকিয়ে শুঁটকি করতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে। শুঁটকির উৎপাদনে কাজ করা প্রতি শ্রমিককে ২৫০টাকা করে প্রতিদিন মজুরি দিতে হয়। উপজেলায় চেউয়া শুঁটকির ৬৫জন পাইকারের পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতা আছেন অন্তত ৩ শতাধিক জন। এছাড়াও দ্বীপ ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বড় বড় পাইকার আসেন ৩৫জনের মত।
শুঁটকির খুচরা ও পাইকারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গত মৌসুমে নদীতে চেউয়া মাছ না পাওয়ায় তাদের প্রচুর লোকসান হয়েছিল। কিন্তু চলতি মৌসুমে সেই লোকসান কাটিয়ে তারা ভালো লাভের আশা করছেন। ইতোমধ্যে এ মৌসুমে ৪ থেকে ৫ ধাপে তারা শুঁটকি উৎপাদন করেছেন। যার সবগুলোই বিক্রি হয়ে গেছে। প্রথম দিকে ১৫'শ টাকা করে ৫০টন, দ্বিতীয় ধাপে ১৭'শ টাকা করে ১৫০টন, তৃতীয় ধাপে ২১'শ টাকা করে ৪হাজার টন এবং চতুর্থ ধাপে ২৫'শ টাকা করে বিক্রি হয়েছে ৪হাজার টন শুঁটকি। চৈত্র মাস পর্যন্ত আরও কয়েকটি ধাপে বিক্রি হবে চেউয়া শুঁটকি। গতবারের তুলনায় নদীতে কয়েকগুণ বেশি মাছ ধরা পড়াতেই এবার শুঁটকির উৎপাদন কয়েকগুণ বেশি হয়েছে।
জঙ্গলিয়া ঘাটের কয়েকজন জেলে জানান, শুধু চেউয়া মৌসুমে এ ঘাটে ২'শত ইঞ্জিনচালিত নৌকা মাছ উৎপাদনে কাজ করে। প্রত্যেকটি নৌকায় একজন করে মাঝির সাথে ২৫-৩০ জন করে জেলে কাজ করেন। সে হিসেবে শুধু মাছ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত এখানকার প্রায় ৩ হাজার জেলে। এর বাইরে চেউয়া শুঁটকি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে আরও প্রায় দুই হাজার মানুষ। এখানে দুই শতাধিক খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা রয়েছে। এছাড়াও এ মৌসুমে জেলেদের পাশাপাশি এ কাজে জড়িত আছেন যানবাহন মালিক-শ্রমিকরাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
তারা আরও জানায়, মৌসুমে মেঘনার এ ঘাট থেকে কাচা মাছ হিসেবে বাজারজাত হয় প্রায় সাত হাজার টনের মতো চেউয়া। এর মধ্যে কিছু তাজা বিক্রি করলেও বাকী সবই শুঁটকি করে ফেলা হয়। এখানকার শুঁটকি লক্ষীপুর, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, চাঁদপুর, মুক্তাগাছা, ত্রিশাল, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে। এ দ্বীপের উৎপাদিত চেউয়া শুঁটকি বড় একটি অংশ দিয়ে মুরগি ও মাছের খাদ্যও তৈরি করা হয়।
জেলেরা বলছেন, প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকার চেউয়া মাছ ও শুঁটকি উৎপাদন হলেও যাতায়াত ব্যবস্থার ও পারাপারের অতিরিক্ত খরচের কারণে আয়ের অংকটা অনেক কমে যাচ্ছে। মূল ঘাটটি মোহাম্মদপুর বাজার সংলগ্ন পূর্ব পাশে। কিন্তু বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার সাথে সাথে চর পড়ে যাওয়ায় নৌকাগুলোকে চলে যেতে হয় মূলঘাটের তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে। ফলে এ পুরো পথ জেলেদের মাথায় কিংবা কাঁধে বোঝা বয়ে এসব মাছ আনতে হয় জঙ্গলিয়া ঘাটের বেড়িতে। ফলে নদী পথেই কাচা মাছ বাজারজাত করতে গিয়ে পাইকাররা অল্প মূল্য দিচ্ছে জেলেদের। আবার শুঁটকির জন্য যেসব মাছ শুকানোর উদ্দেশ্যে আনা হচ্ছে সেখানেও শ্রমিক খরচ বেশি যাচ্ছে। মেঘনার সঙ্গে সংযুক্ত শাখা খালটি (জঙ্গলিয়া খাল) ৩০-৪০ ফুট গভীর ও দুই পাশ সংস্কারের মাধ্যমে চওড়া করে পশ্চিম পাড়ে বেড়ি বাঁধ তথা সড়ক নির্মাণ এবং সরকারীভাবে একটি লেন্ডিং ব্যবস্থা করা হলে শুধু চেউয়া নয়, সব মৌসুমে মাছ ও শুঁটকি উৎপাদন করে লাভবান হবে এ অঞ্চলের জেলেরা। আর এ আয়ের একটি ভাগ সরকারের রাজস্বে যোগ হবে।
জঙ্গলিয়া ঘাটের শুঁটকি ব্যবসায়ী আবুল বাশার মাঝি বলেন, এখানে মাছ ও শুঁটকির বাজার বেশ ভালো। কিন্তু দুর্ভোগ হচ্ছে বাজারজাত করা। শুষ্ক মৌসুমে মেঘনা নদী থেকে মাছের নৌকা ঘাটে আনা সম্ভব হয়না। ফলে স্থানীয় বাজার, জেলা শহর হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠাতে হয়, আর তাতেই বাড়ে খরচ। নদীর সঙ্গে যুক্ত জঙ্গলিয়া খালটি অনেক সরু। ফলে নৌকা নিয়ে মোহাম্মদপুর বাজার সংলগ্ন মূল ঘাটে আসা যায় না। আবার খালের পাশে বেড়ী বা সড়ক না থাকার কারণে পর্যাপ্ত মাছ মাথায় বা কাঁধে ভর করে আনাও অসম্ভব। ফলে বেশিরভাগ সময় বাজারজাত করার জন্য নদীপথই বেছে নিতে হয়। এখানকার উৎপাদিত মাছ দ্রুত দেশের বিভিন্ন বাজারে ছড়িয়ে দিতে জঙ্গলিয়া খালটি খনন ও খাল পাড়ের বেড়ি বাঁধ নির্মাণ করা জরুরী।
স্থানীয় এনায়েত বেপারী বলেন, এখানকার মাছের বাজার বড় করতে হলে মোহাম্মদপুর বাজার হয়ে প্রধান সড়ক অর্থাৎ আফাজিয়া জাহাজমারা সড়ক পর্যন্ত যাওয়ার সকল সড়ক টেকসই সংস্কার করা প্রয়োজন। তাহলে নির্বিঘ্নে জেলেদের উৎপাদিত মাছ ও শুঁটকি দ্রুত দেশের বিভিন্ন বাজারে পৌঁছে দেওয়া যাবে। এতে জেলে, মাঝি ও শ্রমিকদের পাশাপাশি পুরো জনপদের মানুষ আর্থিকভাবে লাভবান হবে।
হাতিয়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অনিল চন্দ্র দাস জানান, চলতি মৌসুমে চেউয়া শুঁটকি উৎপাদনের কোন বিবরণ তার কাছে নেই। অথচ চৈত্র মাসে শেষ হবে চেউয়া শুঁটকির উৎপাদন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আরও কয়েকদিন পর আমরা জেলেদের কাছ থেকে উৎপাদনের হিসেবটা নিবো। তারপর আপনাকে সঠিক তথ্যটা দিতে পারবো'।
তিনি আরও বলেন, 'হাতিয়ার জঙ্গলিয়াঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রচুর শুঁটকির উৎপাদন হয়। এছাড়াও বছর জুড়েই এখানে সাগরের নানান প্রজাতির মাছ ও শুঁটকি উৎপাদন হয়। জঙ্গলিয়া খালটি সংস্কার, বেড়ি নির্মাণ ও লেন্ডিং এর বিষয়ে জেলেদের পক্ষ থেকে আমাদের কিছু জানানো হয়নি। এসব বিষয় লিখিত আকারে পেলে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে'।