১০ বছর পর চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে লঞ্চ সার্ভিস চালু
১০ বছরেরও বেশি সময় পর বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে পরীক্ষামূলকভাবে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে।
বৃহস্পতিবার সকালে ৪০১ জন যাত্রী নিয়ে চট্টগ্রামের সদরঘাট ওয়াটারবাস টার্মিনাল ছেড়ে যাত্রা শুরু করে উপকূলীয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি তাজউদ্দিন। নৌ রুট আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলে এমভি বারো আউলিয়া নামক আরেকটি লঞ্চ যাত্রী পরিবহনে এমভি তাজউদ্দিনের সাথে যোগ দেবে।
২০১১ সালের ২৩ জুন বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে বরিশালের উদ্দেশ্যে বিআইডব্লিউটিসির সর্বশেষ লঞ্চটি ছেড়ে যায়। এরপর কেটে গেছে দশটি বছর।
লঞ্চের সংকটের কারণে বন্ধ ছিলো এই রুটের লঞ্চ চলাচল। এতে দীর্ঘ সময় ধরে ভোগান্তিতে ছিলেন চট্টগ্রামে বসবাসরত বরিশালের বাসিন্দারা।
বরিশালবাসীর সেই দুঃখ ঘুচলো এবার। পরীক্ষামূলকভাবে লঞ্চ চলাচল শুরু হওয়ায় উচ্ছাস প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটের যাত্রী, ব্যবসায়ী ও
উদ্যোক্তারা।
এমভি তাজউদ্দিনের ইনল্যান্ড মাস্টার অফিসার আবু তাহের দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "নাব্যতা সংকট, ডুবো চর ও যাত্রী সংকটের কারণে দীর্ঘ দশ বছর আগে বরিশাল রুটের জাহাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বর্তমানে সাগরের পরিস্থিতি অনেক ভালো। লঞ্চ পরিচালনায় আধুনিক যন্ত্রপাতি যুক্ত করে সরকার আবারও এই রুটে লঞ্চ পরিচালনার সীদ্ধান্ত নিয়েছে।"
"এক সময় চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল যেতে সময় লাগত ২১ ঘণ্টা। আধুনিক প্রযুক্তি সংবলিত লঞ্চ এমভি তাজউদ্দিন ও এমভি বার আউলিয়ার এখন একই পথ পাড়ি দিতে লাগবে মাত্র ১২ ঘন্টা । এতে করে এই রুটে পর্যটনও বিকশিত হবে," বলেন আবু তাহের।
এমভি তাজউদ্দিনের সহকারী ইনল্যান্ড মাস্টার মো রফিকুল ইসলাম টিবিএসকে জানান, ১২ নটিক্যাল মাইল গতিতে চলতে সক্ষম জাহাজ দুটিতে ২৫টি কেবিনসহ ৭৫০টি আসন রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে বরিশালের দূরত্ব প্রায় ২৬১ কিলোমিটার বা ১৪১ নটিক্যাল মাইল। তবে বর্তমানে নাব্যতার কারণে রুট পরিবর্তন করায় এ দূরত্ব আরো ২০ কিলোমিটার বা ১১ নটিক্যাল মাইল বাড়তে পারে।
সরকারি কর্মকর্তা মনোজ কুমার দে। জন্মস্থান বরিশাল হলেও চাকরি সূত্রে থাকেন বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর হয়ে ভোলার ইলিশা-ঘাট হয়ে বরিশাল যেতে একদিকে যেমন সময় লাগে; অর্থ ব্যয়ও হয় প্রচুর।"
"তাই দীর্ঘদিন ধরে আমরা ভোলা সমিতি ও বৃহত্তর বরিশালের বাসিন্দারা এই রুটে লঞ্চের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলাম। আজ আমাদের সেই স্বপ্ন পুরণের দিন, আমরা চাই এই উদ্যোগ অব্যাহত থাকুক," যোগ করেন তিনি।
বিআইডব্লিউ টিসি চট্টগ্রামের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ফয়সাল আলম চৌধুরী বলেন, "সবকিছু ঠিক থাকলে ভাড়া নির্ধারণ শেষে ৯ ডিসেম্বর থেকে নিয়মিত লঞ্চ চলবে এ নৌপথে। এক সপ্তাহে এমভি তাজউদ্দিন এবং পরের সপ্তাহে এমভি বারআউলিয়া যাবে চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল। প্রতি বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম থেকে রওয়ানা হয়ে বরিশাল পৌছাবে এবং শুক্রবার রাতে ফিরতি পথে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবে।"
অর্ধ শতাব্দী প্রাচীন রুটে আবারও ছুটছে লঞ্চ
বিআইডব্লিউটিসি ও এই রুটের যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটটি ঐতিহ্যবাহী নৌ রুট। ১৯৬৪ সালে বরিশাল থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে চট্টগ্রামে পণ্য ও যাত্রীবাহী লঞ্চের চলাচল শুরু হয়।
পরে পশ্চিম জার্মানি থেকে আনা চারটি সমুদ্রগামী জাহাজ দিয়ে চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ-হাতিয়া-বরিশাল রুটটি চালু হয়।
১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে নৌ-পরিবহন কর্পোরেশন এ রুটের জাহাজ এমভি তাজুল ইসলামকে বিক্রি করে দেয়। সার্ভিসটি চালু ছিলো বাকি তিনটি জাহাজ এমভি মতিন, এমভি মনিরুল হক এবং এমডি আলাউদ্দিন আহম্মেদকে দিয়ে। পরবর্তী সময়ে এমভি আলাউদ্দিন আহম্মেদকে পরিত্যক্ত ঘোষণা ও বিক্রি করে দেওয়া হয়।
জাহাজ সংকটে সপ্তাহে মাত্র দুদিনে সার্ভিসটি নেমে আসে। ২০০৯ সালে মেরামতের কথা বলে এমভি মতিন ও এমভি মনিরুল হককে ডকে তোলা হয়। অনিয়মিত ভাবে ২০১১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত চালু থাকার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম-বরিশাল নৌরুটটি।
চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ি মনিরুল ইসলাম বলেন, "২০১১ সালে এই রুটে জাহাজে করেই ভোলা থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলাম। লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগে বিপাকে পড়ে বরিশালগামী মানুষ।"
বিকশিত হবে পর্যটন
দশবছর পর চট্টগ্রাম-বরিশাল রুটে জাহাজ চলাচল নিয়ে আশায় বুক বাঁধছেন চট্টগ্রাম ও বরিশালের ব্যবসায়ী ও পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, যাত্রী সেবার মান ঠিক রেখে এই রুটে লঞ্চ চলাচল অব্যহত রাখলে বিকশিত হবে দেশের পর্যটন খাত; সুযোগ রয়েছে পরিবার নিয়ে ভ্রমণেরও।
ফয়েস লেক কনকর্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্কের উপমহাব্যবস্থাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ টিবিএসকে বলেন, "লঞ্চ চালুর ফলে চট্টগ্রাম থেকে বরিশাল রুটে পর্যটন বিকশিত হবে। বরিশালবাসী চাইলেই চট্টগ্রামের পর্যটন স্পট গুলোতে ভ্রমণ করতে পারবেন।"
"তবে যেহেতু প্রায় ১২ ঘন্টার যাত্রা, তাই এই রুটে পর্যটকদের জন্য খাবার ও টয়লেটের সুযোগ থাকতে হবে। এছাড়া মায়েদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার ও নারীদের যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।"
ভোলার ব্যবসায়ী জমির উদ্দিন বলেন, "লঞ্চে ১২ ঘণ্টায় বরিশাল যাওয়া গেলে, চট্টগ্রাম থেকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাসহ অন্যান্য এলাকায় যাওয়া সহজ হবে। লঞ্চে ভ্রমণের এই যাত্রা হবে রোমাঞ্চকর।"