২০২৬ সাল নাগাদ ঢাকায় আরেকটি সুপার-স্পেশালাইজড হাসপাতাল হচ্ছে
রোগীদের অতি-বিশেষায়িত সেবা দিতে রাজধানীর শাহবাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) কাছেই আরও একটি অতি-বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে সরকার।
ইতোমধ্যে বিএসএমএমইউ-এর অধীনে প্রথম অতি-বিশেষায়িত হাসপাতালের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ফলে ৭৫০ শয্যার প্রস্তাবিত দ্বিতীয় মেডিকেল স্থাপনাটি আগামী পাঁচ বছরে বিএসএমএমইউ ও বারডেম জেনারেল হাসপাতালসহ রাজধানীর শাহবাগকে একটি 'হসপিটাল হাবে' পরিণত করবে বলে জানিয়েছেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের কর্মকর্তারা।
দক্ষিণ কোরিয়ার ২০ কোটি ডলার অর্থায়নে নির্মিত এ হাসপাতালে সাধারণ সার্জারি, গাইনোকলজি, সার্জিক্যাল অনকোলজি এবং ইএনটি ও চক্ষু চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। থাকবে ৫০-৬০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টারও। ১০টি শয্যা শিশুদের জন্য নির্ধারিত থাকবে বলেও জানান কর্মকর্তারা।
প্রস্তাবিত অতি-বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রকল্পের পরিচালক জুলফিকার রহমান খান আশা প্রকাশ করেন যে, এই চিকিৎসাকেন্দ্র সেবার মানে দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে ব্যয়বহুল দুটি হাসপাতাল, স্কয়ার বা এভারকেয়ার হাসপাতালের সঙ্গে পাল্লা দেবে।
তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'রোগীদের বিদেশমুখীতা কমাতে সুপার-স্পেশালাইজড সার্ভিস বাড়ানোর জন্য এ হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে। রোগীরা মূলত হাসপাতালের উন্নত পরিবেশ ও চিকিৎসাসেবার জন্য বিদেশে যায়। অথচ আমাদের দেশেও ভালো বিশেষায়িত চিকিৎসক আছেন। আমরা যদি তাদের চিকিৎসার দক্ষতা ও সুদক্ষ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে রোগীদের বিদেশমুখীতা কমবে।'
প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ বাংলাদেশি চিকিৎসাসেবা নিতে বিদেশে যান। মেডিকেল পর্যটনের গন্তব্য হিসেবে এক নম্বর স্থানে আছে প্রতিবেশী ভারত। তারপরই রয়েছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দুবাই। তবে ২০২০ ও ২০২১ সালে মহামারির কারণে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ থাকায় চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়ে খরচের পরিমাণ নজিরবিহীনভাবে কমতে দেখা গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো 'অতি-বিশেষায়িত' হাসপাতাল নেই। বিএসএমএমইউই দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা সুবিধা প্রদানকারী কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত।
বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হসপিটাল ওয়ান স্থাপিত হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থায়নে। হাসপাতালটি নির্মাণ করতে ১২.২২৫ কোটি ডলার অর্থায়ন দেওয়া হয়েছে। এই হাসপাতালটির উদ্বোধন হওয়ার কথা আছে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে।
আর এগারোতলার দ্বিতীয় হাসপাতালের নির্মাণকাজ তিন বছরে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিএসএমএমইউয়ের পূর্ব দিকে সাবেক বেতার ভবনের তিন একর জমিতে দ্বিতীয় হাসপাতালটি নির্মিত হবে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, প্রথম চিকিৎসা অবকাঠামোর অগ্রগতি 'প্রশংসনীয়' হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়া দ্বিতীয়টিতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখিয়েছে। দ্বিতীয় হাসপাতাল নির্মাণের সম্পূর্ণ অর্থায়নই দক্ষিণ কোরিয়া করবে। বাংলাদেশ শুধু বিদেশি অর্থায়নের শুল্ক পরিশোধ করবে।
কর্মকর্তারা জানান, বিএসএমএমইউ, সুপার-স্পেশালাইজড হাসপাতাল এক ও দুই এবং বারডেম জেনারেল হাসপাতালের সমন্বয়ে শাহবাগ আগামী পাঁচ বছরে 'হসপিটাল হাবে' পরিণত হবে। এই হাসপাতালগুলোতে সব মিলিয়ে শয্যাসংখ্যা হবে ৪ হাজারের বেশি।
সব বিভাগই ফলিত (অ্যাপ্লাইড)
এগারোতলার দ্বিতীয় অতি-বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঁচ-ছয়টি কোর বিভাগ ও সেগুলোর উপবিভাগ (সাব-ডিপার্টমেন্ট) থাকবে। এছাড়া রিসার্চ সেন্টার, স্কিল ল্যাব, লেকচার থিয়েটার, লাইব্রেরি ও বঙ্গবন্ধু মিউজিয়াম থাকবে।
জুলফিকার রহমান খান বলেন, প্রথম হাসপাতালে যে ফলিত (অ্যাপ্লাইড) বিভাগগুলো নেই, প্রধানত সেই বিভাগগুলো থাকবে দ্বিতীয় হাসপাতালে।
বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল ওয়ান-এ থাকবে ১০০ শয্যার অ্যাক্সিডেন্ট ইমার্জেন্সি সুবিধা; একটি লিভার, গল ব্লাডার ও প্যানক্রিয়াস সেন্টার; অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র; ক্যান্সার সেন্টার; মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র; এবং ডেন্টাল সেন্টার। এছাড়াও থাকবে কার্ডিওভাসকুলার সেন্টার, জেরিয়্যাট্রিক সেন্টার, স্পাইনাল কর্ড সেন্টার, বার্ন ইনজুরি সেন্টার, একটি হেলথ স্ক্রিনিং সেন্টার এবং একটি জরুরি চিকিৎসা কেন্দ্র।
জুলফিকার রহমান খান জানান, দ্বিতীয় অতি-বিশেষায়িত হাসপাতালে জেনারেল সার্জারির বিভিন্ন বিভাগ ও উপবিভাগ থাকবে। এছাড়াও থাকবে গাইনি বিভাগ, সার্জিক্যাল অনকোলজি, এবং একটি ইএনটি ও চক্ষু বিভাগ। এছাড়া শিশুদের জন্য ১০টি ডেডিকেটেড পেডিয়াট্রিক ডায়ালাইসিস শয্যাসহ ৫০-৬০ শয্যার ডায়ালাইসিস সেন্টারও থাকবে হাসপাতালটিতে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, শুরুতে দ্বিতীয় হাসপাতালটি ২০-তলা ভবন হওয়ার কথা ছিল। কিন্ত তেজগাঁও পুরাতন বিমান বন্দরের আশেপাশে উচ্চ ভবন নির্মাণ নিষিদ্ধ থাকায় পরে ভবনটি ১১-তলা পর্যন্ত নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। এ কারণে হাসপাতালে শয্যাসংখ্যা ১ হাজার থেকে কমে ৭৫০-তে নেমে এসেছে।
হাসপাতালটিতে চারটি বেজমেন্টে ৪০০ গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে। প্রথম সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে দুটি বেজমেন্টে ২৫০ গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।
রোগীদের প্রবেশের সুবিধার জন্য দুই হাসপাতালের মধ্যে ওভারহেড বা আন্ডারগ্রাউন্ড সংযোগ করিডোর থাকবে। প্রতিটি হাসপাতালের প্রশাসন আলাদা হবে। যদিও দুটো হাসপাতালের প্রশাসনই বিএসএমএমইউয়ের অধীনে থাকবে।
অর্থায়ন ও নির্মাণের পর্যায়
বিএসএমএমইউ সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতাল নির্মাণের জন্য কোরিয়ান সরকারের এক বছরের সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
সম্ভাব্যতা যাচাই শেষে নির্মাণ বাজেটের খসড়া প্রস্তুত করা হবে। এরপর ঢাকা ও সিউলের মধ্যে ঋণ চুক্তি সই হবে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির শেষ করে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় উপস্থাপন করা হবে।
একনেকের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার পর দরপত্র আহ্বানের মাধ্যমে কোরিয়ান ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে এবং নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
জুলফিকুর রহমান খান জানান, সব প্রাথমিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২০২২ সাল চলে যাবে। হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হবে ২০২৩ সালে। কাজ হবে তিন বছর মেয়াদে।
তিনি বলেন, 'এ হাসপাতালে যে স্ট্যান্ডার্ড মেইনটেইন করা হচ্ছে, বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালের সে স্ট্যান্ডার্ড নেই। ম্যানেজমেন্ট ভালো হলে বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলোর চেয়েও এই হাসপাতালের সেবার মান উন্নত হবে। তবে চ্যালেঞ্জ হলো ম্যানেজমেন্ট। প্রপার ম্যানেজমেন্ট না হলে সব শেষ হয়ে যাবে।'