৫২ ভাগ জনবল দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কার্যক্রম
দেশের সবচেয়ে বড় শুল্ক স্টেশন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস। বর্তমানে এক অর্থবছরে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করে এই শুল্ক স্টেশন। প্রতি অর্থবছরে গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও ৫২ ভাগ জনবল দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কার্যক্রম।
এর ফলে কাস্টম হাউসের কর্মকর্তাদের নিতে হচ্ছে বাড়তি কাজের চাপ। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারায় শুল্কায়নে বিলম্ব হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য খালাসে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, জনবল সংকটের সুযোগ নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি কিংবা চোরাচালানের আশ্রয় নিচ্ছে একটি চক্র। জনবল বাড়াতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের পক্ষ থেকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে একাধিকবার চিঠি দিয়েও এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম টিবিএসকে বলেন, ২০১১ সালের জনবল কাঠামো অনুযায়ী কাস্টম হাউসের কার্যক্রম চলছে। জনবল সংকটের কারণে স্বাভাবিক কাজের ব্যাঘাত ঘটছে। জনবল বাড়াতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অবহিত করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের চলতি বছরের ১ জুনের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে মঞ্জুরীকৃত ১,২৪৮টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছে ৬৪৭টি। শূন্য পদ ৬০১টি। অনুমোদিত পদের তুলনায় শূন্য পদের হার ৪৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।
জনবল কাঠামো অনুযায়ী, প্রথম শ্রেণীর ২১০ জনবলের বিপরীতে শূন্যপদ ৯৪ টি, দ্বিতীয় শ্রেণীর ৪৯৭ জনবলের বিপরীতে শূন্যপদ ২৩১ টি, তৃতীয় শ্রেণীর ৪২৩ জনবলের বিপরীতে শূন্যপদ ২৫৪ টি এবং চতুর্থ শ্রেণীর ১১৮ জনবলের বিপরীতে শূন্যপদ আছে ২২ টি।
জনবল কাঠামো অনুযায়ী চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে মোট ৫০ ক্যাটাগরির জনবল রয়েছে। এর মধ্যে ১৩ ক্যাটাগরিতে কোন জনবলই নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এগুলো হচ্ছে উপ-প্রধান রাসায়নিক পরীক্ষক, সহ:রাসায়নিক পরীক্ষক, প্রোগ্রামার, সহকারী পরিচালক পরিসংখ্যান, পরিসংখ্যান অনুসন্ধায়ক, প্রধান হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, সহকারী হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, পরিসংখ্যান কর্মকর্তা, অডিটর, স্পীড বোড ড্রাইভার, ডাটা এন্ট্রি অপারেটর, রেকর্ড সাপ্লাইয়ার এবং কুক।
কাস্টমসের রাসায়নিক পরীক্ষাগারে জনবল সংকটের কারণে রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পেতে ১৫ দিনেরও বেশি অপেক্ষা করতে হয় বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা।
কাস্টমসের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আমদানি রপ্তানি সংক্রান্ত একটি ফাইল ভালোভাবে দেখতে একজন কর্মকর্তার অন্তত ২০ মিনিট সময়ের প্রয়োজন। জনবল সংকটের কারণে একটি ফাইলে ১০ মিনিটের বেশি সময় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে কাজের মান কমে যাচ্ছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমস এক্সাইজ এন্ড ভ্যাট এক্সিকিউটিভ অফিসার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি এবং বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা আমজাদ হোসেন হাজারী বলেন, জনবল সংকটের কারণে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জেটি এবং অডিট ইনভেস্টিগেশন এন্ড রিসার্স (এআইআর) শাখার কর্মকর্তাদের দৈনিক ১৬ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হচ্ছে।
অন্য শাখার কর্মকর্তাদেরও একই অবস্থা। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে আমদানি রপ্তানির পণ্য চালানের ডকুমেন্ট ভালোভাবে দেখে অনুমোদন দেওয়া। পর্যাপ্ত সময় নিয়ে কাজ করতে গেলে সিএন্ডএফ এজেন্ট কর্মীরা দ্রুত ফাইল অনুমোদনের জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। এ কারণে কাস্টম কর্মকর্তারা উভয় সংকটে রয়েছে।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য মতে, ২০১০-১১ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২০,৩৭২ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আদায় হয়েছে ৪৪,৮৩৪ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে এই সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকায়।
১১ অর্থবছরের ব্যবধানে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় বাড়লেও জনবল কাঠামো পরিবর্তন কিংবা জনবল কাঠামো অনুযায়ী নিয়োগও দেওয়া হয়নি। নির্দিষ্ট শ্রমঘন্টার চেয়ে অতিরিক্ত কাজ করতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস থেকে অন্য শুল্ক স্টেশনে বদলীর জন্য তোড়জোড় করেন অনেক কর্মকর্তা।
সহকারী কমিশনার পদের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, শ্রমঘন্টার দ্বিগুণ কাজ করেও কাস্টম হাউসের দিনের কাজ দিনে শেষ করা সম্ভব হয়না। বাড়তি কাজের চাপে কর্মকর্তারা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিবার পরিজনকে সময় দেওয়াও দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই বেশিরভাগ কর্মকর্তা অন্যত্র বদলী হওয়ার চেষ্টায় থাকেন।
সিএন্ডএফ এজেন্টস কর্মচারী এসোসিয়েশনের সাবেক যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মো: মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, কাস্টম হাউসে জনবল সংকটের কারণে আমদানি রপ্তানি পণ্যের ফাইল অনুমোদনে রীতিমতো বেকায়দায় পড়তে হয়। সময়মতো ফাইল অনুমোদন না পাওয়ায় বন্দর থেকে সঠিক সময়ে পণ্য খালাস নেওয়া যায়না। এতে সিএন্ডএফ এজেন্ট কর্মীদের হয়রানির পাশাপাশি আমদানিকারকদের বাড়িত টাকা গুনতে হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন শুধু সমস্ত জনবল নিয়োগ নয় ভবিষ্যত ব্যবসার পরিধি কেমন হবে তা বিবেচনা করে এখন থেকেই জনবল কাঠামো পরিবর্তন করে নিয়োগ করা উচিত।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ সভাপতি এবং প্যাসিফিক জিন্স এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, এই জনবল সংকটেও কাস্টমস যেভাবে তার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু দেশে ব্যবসার পরিধি যেভাবে বাড়ছে তার সাথে তাল মিলিয়ে এবং আগামী ১০ বছরের ব্যবসার পরিধি কি পরিমাণ বাড়বে তার হিসাব করে কাস্টমকে এখনই জনবল কাঠামো রিভিউ করা উচিত। একই সাথে দক্ষ জনবল ও তথ্য প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও এগিয়ে যাওয়া উচিত।