‘মিয়ানমার থেকে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা আসছে’
ইয়াবা ব্যবসার ঘৃণ্য জগত ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন কক্সবাজারের ২১ জন ইয়াবা কারবারি। এ লক্ষ্যে বিশাল এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে কক্সবাজার পুলিশ যা দেখতে আসে হাজারো জনতা।
সোমবার বিকেলে টেকনাফ সরকারি কলেজের মাঠে হাজার হাজার মানুষের সামনেই ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে এই ইয়াবা কারবারিদের নতুন জীবনে স্বাগত জানান পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক।
আত্মসমর্পণ করা ২১ জন ইয়াবা কারবারি অনুষ্ঠানে পুলিশের কাছে ১০টি অস্ত্র, ২১ হাজার পিস ইয়াবা ও ৩০ রাউন্ড তাজা কার্তুজ হস্তান্তর করে। তারা সবাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত ইয়াবা কারবারি ও হুন্ডি ব্যবসায়ী।
দ্বিতীয় দফায় আত্মসমর্পণকারীরা হলেন, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ফুলের ডেইল গ্রামের ফকির আহমদের ছেলে নুর মোহাম্মদ, নুর কবিরের ছেলে ইমাম হোসেন, হোয়াইক্যং উত্তরপাড়ার মৃত আব্দুর শুক্কুরের ছেলে ফরিদ আলম, মহেশখালীয়াপাড়ার মৃত নুরুল ইসলামের ছেলে শাহাদাত হোছাইন, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের মৌলভী পাড়ার বাসিন্দা হাজী ফজল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ রিদওয়ান ও তার ভাই আব্দুর রাজ্জাক, সুলতান আহমদের ছেলে বশির আহমদ, মৃত আমির হোসেনের ছেলে ও সাবেক ছাত্রদল নেতা আব্দুল আমিন আবুল, মৃত লাল মিয়ার ছেলে আবুল কালাম, মৌলভীপাড়ার ছৈয়দ হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ রাসেল ওরফে হাজি রাসেল, রুহল আমিনের ছেলে ফজল করিম, সাবরাং ইউনিয়নের লেজির পাড়ার মৃত হাজী মকতুল হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ ইদ্রিস, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের উত্তর লম্বরী পাড়ার জহির আহমদের ছেলে আবু তৈয়ূব ওরফে মধু, মাঠপাড়ার ফজলুর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ জাহেদ, খয়রাতি পাড়ার আবুল কালাম সওদাগরের ছেলে মোহাম্মদ সাদ্দাম, টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লান পাড়ার মৃত কামাল হোসেনের ছেলে আব্দুল নূর, লামার বাজারের আব্দুল জলিলের ছেলে মোহাম্মদ ইসমাঈল, সাবরাং ইউনিয়নের সিকদার পাড়ার মৃত ছৈয়দুর হোসেনের ছেলে আব্দুল গফুর, সাবরাং সিকদারপাড়া আমির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ হোসেন কালু, হ্নীলা ইউনিয়নের উলুচামোরি কোনারপাড়ার আবুল কালামের ছেলে মিজানুর রহমান।
আত্মসমর্পণ করা এই ২১ জনকে সংশ্লিষ্ট আইনে মামলা রুজু করে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম পুলিশ রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, “১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করে বাংলাদেশের উপর চাপিয়ে দিয়েছে মিয়ানমার। সেই মিয়ানমার থেকে বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকার ইয়াবা আনছে এদেশীয় ইয়াবা কারবারিরা। দেশের টাকা বিদেশে পাচার মানে নিজেদের পায়ে কুড়াল মারার মতো। মাদক-দুর্নীতি ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী জিরো ট্রলারেন্সে রয়েছে। তার (প্রধানমন্ত্রীর) নির্দেশনা বাস্তবায়নে মাঠে কাজ করছে পুলিশ। আজকের আত্মসমর্পণ তারই একটি অংশ।”
তিনি আরও বলেন, “৯০ দশকের শেষের দিকে জঙ্গিবাদ চরমভাবে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। জিরো ট্রলারেন্স নীতির কারণে জঙ্গিবাদ দমনে সফলতা পেয়েছি আমরা। ইয়াবাও বন্ধ হবে, ইনশাআল্লাহ। দোষ স্বীকার করে যারা আত্মসমর্পণ করেছেন, তাদের সাধুবাদ জানাই। যারা এখনো বাইরে রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে।”
আত্মসমর্পণকারীদের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মোহাম্মদ তৈয়ব বলেন, “ইয়াবা কারবার অঢেল টাকা দেয়, কিন্তু শান্তি দেয় না। অভিযান শুরুর পর থেকে একটি রাতও ঘরে থাকতে পারিনি। স্বজনদের সঙ্গে করতে পারিনি একটি ঈদও। ভোগান্তিতে থাকে পরিবার-পরিজনরাও। তাই অপরাধ বুঝতে পেরে আত্মসমর্পণ করেছি। যারা বাইরে রয়েছেন, তাদের প্রতি অনুরোধ শান্তি চাইলে আপনারাও ঘৃণিত এ পেশা ছেড়ে আইনের আওতায় আসুন।”
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, জেলা কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি তোফায়েল আহমদ, সাধারণ সম্পাদক সোহেল আহমদ বাহাদুর, কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসেন, টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, টেকনাফ পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম, টেকনাফ উপজেলা কমিউনিটি পুলিশের সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা ও মৌলানা মুফতি কিফায়েত উল্লাহ। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন।
গত জানুয়ারি মাসে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৯ মাদক কারবারি নিহত হয়েছেন। এদের মাঝে ৬ জন রোহিঙ্গা। এর আগে ২০১৮ সালের মে থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় বিশেষ অভিযানে ৫৬ রোহিঙ্গাসহ ২০৯ জন ইয়াবা কারবারি ও ডাকাত-সন্ত্রাসী ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
এ সময়ে ১ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার ৫৭০ পিস ইয়াবাও জব্দ হয় বলে জানায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটক হন ২ হাজার ৩৩৮ জন। এসব ঘটনা মাদক কারবারিদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। ফলে অনেক চিহ্নিত ইয়াবা কারবারি গা-ঢাকা দেন এবং অনেকেই আত্মসমর্পণ করতে মরিয়া হয়ে ছুটছেন। এর আগে গত ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আত্মসমর্পণ করেন ১০২ জন। এদের মধ্যে একজন কারাগারে মারা গেছেন। বাকি ১০১ জনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে চার্জশিট দাখিল করেছে টেকনাফ থানা পুলিশ।