বার্ষিক বৃদ্ধির হার ১.২২%, মোট জনসংখ্যা ১৬.৫ কোটি
দেশব্যাপী টানা বৃষ্টি আর সিলেট বিভাগ ছাড়াও দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যার মধ্যে পরিচালিত গণনায় সারা দেশে ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ মানুষের সংখ্যা পেয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। এর মধ্যে পুরুষ ও নারীর সংখ্যা যথাক্রমে ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ এবং ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬। এরই মাধ্যমে দেশে নারীর সংখ্যা পুরুষের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। এর বাইরে দেশে তৃতীয় লিঙ্গ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯; এছাড়াও ৮৫ হাজার ৯৫৭ জনের লৈঙ্গিক পরিচয় চিহ্নিত করা যায়নি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক ফলাফলে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বুধবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জনসংখ্যার সর্বশেষ প্রতিবেদন তুলে ধরেন পরিসংখ্যান ও তথ্যবিজ্ঞান বিভাগের উপসচিব ও প্রকল্প পরিচালক দিলদার হোসেন।
এ সময় তিনি জানান, ২০১১ সালে পরিচালিত জনশুমারির প্রাথমিক ফলাফলে জনসংখ্যা ছিল ১৪.২৩ কোটি। এর মধ্যে পুরুষ ও নারীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭২১০৯৭৯৬ জন ও ৭১৯৩৩৯০১ জন। এ হিসাবে গত ১১ বছরে জনসংখ্যা বেড়েছে ২ কোটি ১১ লাখ জন বা ১৪.৪৪%। এ সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বার্ষিক গড় হার ১.২২ শতাংশ।
বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালেই দেশে জনসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৮২ লাখের বেশি। আর গত অর্থবছরের জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রতিবেদনে জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৭.০৮ কোটি। জনশুমারিতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর ধারণার চাইতেও জনসংখ্যা কম পাওয়া যাওয়ায় তথ্যের গুণগত মান নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। তারা এই শুমারির তথ্যের যথার্থতা যাচাই করতে স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দ্রুত পোস্ট এনুমারেশন চেক (পিইসি) পরিচালনার তাগিদ দিয়েছেন।
দুই বছর আগে হাতে নেয়া প্রকল্পের আওতায় ট্যাব সংগ্রহে জটিলতার কারণে সময়মতো তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করতে পারেনি বিবিএস। সর্বশেষ ১৫ জুন থেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হওয়ার পর দিন থেকেই সারা দেশে তুমুল বৃষ্টিপাত শুরু হয়। সিলেট বিভাগের অধিকাংশ এলাকা বন্যার পানিতে ভেসে যায়। এসব জেলায় তথ্য সংগ্রহে গণনাকারীদের বাড়তি সাত দিন সময় দেয়া হয়।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০০১ সালে পরিচালিত আদমশুমারিতে সারা দেশে জনসংখ্যা বছরে ১.৫৮ শতাংশ হারে বাড়লেও সিলেট বিভাগে বেড়েছিল ১.৬% হারে। আর ২০১১ সালে বিভাগটিতে বার্ষিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ২.১%।এবারের শুমারিতে যথাযথভাবে তথ্য সংগ্রহ না হওয়ায় বিভাগটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ০.৯৬ শতাংশে নেমে এসেছে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে প্রায় চার লাখ ট্যাব ব্যবহার করে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল পদ্ধতিতে শুমারি পরিচালনা করায় দেশের মানুষের প্রকৃত সংখ্যা পাওয়া গেছে বলে অনুষ্ঠানে দাবি করেন পরিসংখ্যান বিভাগ ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা। এর আগে পরিচালনা করা প্রতিবেদনগুলোতে জনসংখ্যার তথ্য 'পারসেপশানের' ভিত্তিতে দেয়া হয়েছিল বলে তারা দাবি করেন।
প্রকল্প পরিচালক মো. দিলদার হোসেন তার উপস্থাপনায় বলেন, দেশের প্রথমবার ডিজিটাল জনশুমারিতে ডিজিটাল ডিভাইস ট্যাবলেট ব্যবহার করে কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড পার্সোনাল ইন্টারভিউ (সিএপিআই) পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। কোন খানা বা হাউসহোল্ড গণনা থেকে বাদ না পড়া বা একাধিকবার গণনা না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সিস্টেম (জিআই এস) ও জিওকোড সমন্বয় করে ডিজিটাল ম্যাপ প্রস্তুত ও শুমারিতে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রায় ৩.৭০ লাখ নির্ধারিত এলাকার প্রতিটি বাসগৃহ, খানা ও ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।
তিনি জানান, ১৯৭৪ সালে দেশের প্রথম আদমশুমারিতে জনসংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭১ জন যা ৫০ বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এবারের শুমারি অনুযায়ী সর্বাধিক জনসংখ্যা ঢাকা বিভাগে, ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ১০৭ জন।
জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭ জন। এছাড়া দক্ষিণ সিটির ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫ জন যোগ করে রাজধানী শহরে জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জনে। বরিশাল সিটি কর্পোরেশনে ৪১৯,৩৫১ জন মানুষের তথ্য পেয়েছে বিবিএস। সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করেন ৩৯,৩৫৩ জন। সর্বনিম্ন ঘনবসতিপূর্ণ সিটি করপোরেশন রংপুরে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করেন ৩,৪৪৪ জন।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ সালে প্রতি ১০০ নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ছিল ১০৮ জন। ১৯৮১-২০০১ এর হারে ১০৬ জনে স্থির ছিল। ২০১১ সালে লিঙ্গানুপাত এর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০০.৩ জনে। বর্তমানে প্রতি ১০০ জন নারীর বিপরীতে পুরুষের সংখ্যা ৯৮ জন। বিভাগভিত্তিক লিঙ্গানুপাত পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঢাকা বিভাগে লিঙ্গানুপাত সর্বোচ্চ (১০৩.৪০) এবং চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বনিম্ন (৯৩.৩৮)।
গত ১১ বছরে দেশে হিন্দু জনসংখ্যার হার ০.৫৯ শতাংশীয় পয়েন্ট কমে দাঁড়িয়েছে ৭.৯৫ শতাংশে। ২০১১ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার ৮.৯৪ শতাংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। একই সঙ্গে বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার হারও কমেছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২২ সালে দেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯১.০৪ শতাংশে। ২০১১ সালে দেশের জনসংখ্যার ৯০.৩৯% ছিল মুসলিম। এ হিসাবে ১১ বছরে মুসলিম জনসংখ্যার অংশ বেড়েছে ০.৬৫%।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ১.৩৩ শতাংশ কমেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের হার। ২০১১ সালে বিভাগটির ১২.৮৫% মানুষ ছিল হিন্দু। চলতি বছরে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১১.৫২ শতাংশে। আট বিভাগের মধ্যে খুলনায় তৃতীয় সর্বোচ্চ হিন্দু রয়েছে।
প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সিলেট বিভাগে সর্বোচ্চ ১৩.৫% হিন্দু জনসংখ্যা রয়েছে। ২০১১ সালে এর হার ছিল ১৪.০৫%। এ হিসাবে বিভাগটিতে ১১ বছরে হিন্দু সম্প্রাদায়ের জনসংখ্যার হার কমেছে ০.৫৫%।
ময়মনসিংহ বিভাগে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের হার সর্বনিম্ন ৩.৯২ শতাংশ।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ১৯৭৪ সালে দেশের প্রথম আদমশুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ১৩ দশমিক ৫ শতাংশ। এরপরের প্রতিটি শুমারিতে হিন্দু জনসংখ্যার হার কমেছে।
দেশের মোট জনসংখ্যার ২,৩৬১,৬০৪ জন (১.৪৩%) এর অন্তত এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। এতে বলা হয়েছে, মোট পুরুষের ১.৬৩% এবং মোট নারীর ১.২৩% এর কমপক্ষে এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা রয়েছে।
সাত বছর বা এর বেশি বয়সী মানুষের স্বাক্ষরতা হারে বড় ধরনের উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। এতে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশে পুরুষ ও নারীদের সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬%, যা পল্লী এলাকায় ৭১.৫৬% এবং শহর এলাকায় ৮১.২৮%।
পাঁচ বছর বা এর বেশি বয়সী মানুষের ৫৫.৮৯% শতাংশের এবং ১৮ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের মধ্যে ৭২.৩১% জনসংখ্যার নিজ ব্যবহারের মোবাইল ফোন রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশে বস্তি এলাকায় ১,৮০০,৪৮৬ জন মানুষ বসবাস করেন। আর ভাসমান আছেন ২২,১৮৫ জন। বস্তিতে বসবাসরত জনসংখ্যা এবং ভাসমান লোকের সংখ্যা ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ (যথাক্রমে ৮৮৪,৪৯৬ জন ও ৯,৪৭০ জন)। পক্ষান্তরে ময়মনসিংহ বিভাগে বস্তিতে বসবাসরত জনসংখ্যা এবং ভাসমান লোকের সংখ্যা সর্বনিম্ন (যথাক্রমে ৩৬,৪৯১ জন ও ৬৯৬ জন)।
স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, 'অনুমান নির্ভর জনসংখ্যা তথ্যের দিন শেষ হয়ে গেছে। জনশুমারির তথ্য আসায় এখন সঠিক তথ্য হচ্ছে সাড়ে ১৬ কোটি মানুষ আছে এই দেশে।'
তিনি আরও বলেন, 'পুরুষের চেয়ে দেশে নারীর সংখ্যা কিছুটা বেশি। কাজেই দেশের উন্নয়নের মূল ধারায় নারীদের সম্পৃক্ত করাটা কতটা জরুরী তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।'
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, 'দেশে ভাসমান লোকের সংখ্যা কম। এর মানে হলো দরিদ্র্য মানুষের সংখ্যা কমছে। নির্ভরশীল জনসংখ্যার হার কমেছে। জনমিতির সুবাতাস পাওয়া যাচ্ছে। সংশয়বাদীদের বলবো বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে সম্পূর্ণ পেশাদারিত্ব নিয়ে কাজ করা হয়েছে। তারপরও ভুল ক্রুটি থাকলে সেগুলো সংশোধন করা হবে।'