পান্থকুঞ্জ পার্ক এখন মাদক, ছিনতাই আর যৌনকর্মীদের আখড়া
রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারার পাশে হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ের বিপরীতে অবস্থিত পান্থকুঞ্জ পার্ক যেন হয়ে উঠেছে চরম অস্বস্তি ও আতঙ্কের নাম। কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতায় পার্কটি এখন ময়লার ভাগাড় ও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সন্ধ্যা নামলেই ছিনতাই, ভাসমান যৌনকর্মীদের অনৈতিক কাজ, মাদক সেবন ও ব্যবসার নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে এ পার্কটি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় ৫ একর আয়তনের পার্কটি চার বছরেরও বেশি সময় ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে। পার্কটির সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য ১৯ কোটি ২০ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়ে ২০১৮ সালে উন্নয়ন কাজ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কাজ শুরুর পর থেকে পার্কটিকে দুই বার টিনের প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি কিছু অংশের প্রাচীর রেখে বাকি অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে।
এ এলাকার লোকজন এবং পথচারীরা বলছেন, পার্কে বর্জ্য ফেলায় এবং মলমূত্রের দুর্গন্ধে এটি এখন চরম অস্বস্তির জায়গা। এ অংশের রাস্তা অতিক্রমের সময় তাদের আতঙ্কে থাকতে হয়। রাতে পার্কটির মধ্য দিয়ে চলাচল করা তো দূরের কথা, দিনেও এর মধ্যে যেতে ভয় পান তারা। সন্ধ্যার পরে পার্কটির পাশের রাস্তায় হরহামেশাই ঘটে ছিনতাই, দিনে চলে মাদক সেবন ও বেচাকেনা।
পুলিশ বলছে, এ অংশে কোনো সড়কবাতি না থাকায় তাদেরও বেগ পেতে হয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে। যদিও তাদের মতে, এখানে সার্বক্ষণিকই থাকছে পুলিশের একটি মোবাইল টিম।
দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বলছে, রাজধানীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের চলমান কাজের জন্য পান্থকুঞ্জ পার্কটির উন্নয়ন কাজ শুরুর পরেও বন্ধ রাখা হয়। এ পার্কটির ভিতরে কয়েকটি খুঁটি পড়বে, যার জন্য কয়েকটি স্থান চিহ্নিত করা হয়েছে তাই পরিপূর্ণ সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে চার বছরেরও অধিক সময়।
ত্রিভুজ আকৃতির পার্কটির পশ্চিমপাশে রয়েছে কাঁঠালবাগান আবাসিক এলাকা, পূর্ব পাশে অভিজাত প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল এবং দক্ষিণ দিকে বাংলামোটর। দুটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কও চলে গেছে এই পার্কের দু'পাশ দিয়ে- একটি কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ এবং অন্যটি সি আর দত্ত সড়ক।
দিনে-রাতে পান্থকুঞ্জ পার্ক সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, পার্কের পশ্চিম পাশের কিছু অংশের টিনের প্রাচীর ছাড়া বাকি প্রাচীর তুলে নেওয়া হয়েছে। পার্কের মধ্যে ঝোপঝাড় আর ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। পার্ক আধুনিকায়নের জন্য শুরুতে ভেতরে যে কয়টি ড্রেন করা হয়েছিল, সেগুলোও মশা আর পোকামাকড় উৎপাদনের আবাসস্থল। পার্কের বড় একটা অংশ খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন আর সেটির অস্তিত্ব নেই। খোলা স্থানেও ছড়িয়েছিটিয়ে কিংবা স্তুপ আকারে আছে ইট, সুরকি। রাখা আছে ড্রেনে ব্যবহারের পাইপও। পার্কের দক্ষিণ পাশে তৈরী করা টিনের দুটি ঘরে রাখা আছে বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রী।
পার্কের মধ্যে অন্তত চারটি স্থানে তৈরী করা হয়েছে অস্থায়ী ঘর। উত্তর দিকের স্থাপনাগুলো ময়লা আবর্জনায় জরাজীর্ণ। এছাড়াও পার্কের বিভিন্ন স্থানে পড়ে থাকতে দেখা যায় নানা অপরাধ কর্মে ব্যবহৃত বর্জ্য। দেখা মেলে ছিনতাই হওয়া মানিব্যাগ, মোবাইলের কভার, ভ্যানিটি ব্যাগেরও।
বাংলামোটর থেকে কারওয়ান বাজারের রাস্তায় সামান্য দূরত্বের এই পথে সিগন্যালের কারণে যানজট লেগেই থাকে। ফলে ফুটপাথ ধরে হেঁটে যাওয়া, সিগন্যালে পড়ে বাসে বসে থাকা যাত্রীদের ফোন ছোঁ মেরে মুহূর্তে অন্ধকার পার্কে হারিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
এ পার্কের ভিতরে এবং পাশের রাস্তা ও ফুটপাতে নেই কোনো লাইটের ব্যবস্থা। ছিনতাইকারী ও হিজড়াদের দিয়ে অনৈতিক কাজ করানো সিন্ডিকেটের লোকজনের কারণে এসব লাইট থাকে না বলে দাবি সিটি কর্পোরেশনের।
পার্কের মধ্যে দুটি টিনের ঘরে রাখা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু নির্মাণসামগ্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মো. শাহিন টিবিএসকে বলেন, 'এমন কোনো বাজে কর্মকাণ্ড নেই যা এ পার্কের মধ্যে হয় না।'
কয়েকদিন আগে বাংলামোটর থেকে কারওয়ান বাজার যেতে এ পার্কের পাশে এসে যানজটে পড়লে শফিকুল ইসলামের হাত থেকে ছোঁ মেরে জানালা দিয়ে মোবাইল ফোন নিয়ে যায় এক ছিনতাইকারী। বাস থেকে নেমে ছিনতাইকারীকে তাড়া করলে পার্কের ভিতরে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
শফিকুল টিবিএসকে বলেন, 'আমার মোবাইল নিয়ে পার্কের অন্ধকারে চলে গেলে আমিও পেছনে দৌড় দেই কিন্তু একটু ভিতরে গেলেই ছিনতাইকারী উল্টো আমাকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাড়া করে। পরে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে আসি।'
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'ঢাকার এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের পার্কের মধ্যে সবার চোখের সামনেই এ অপকর্মগুলো হচ্ছে। এগুলো দেখার কি কেউ নেই? কেন আমরা নিরাপদে পথ চলতে পারবো না?'
পথচারী শিবলু টিবিএসকে বলেন, 'এ পার্কে যেমন দুর্গন্ধ তেমনি মাদকসেবী ও ছিনতাইকারীদের আড্ডাখানা। যৌনকর্মী ও হিজড়াদের কারণে এ রাস্তা দিয়ে হাঁটাই দুষ্কর। জনগণের পার্ক এখন জনগণের জন্যই আতঙ্কের।'
এ বিষয়ে ডিএমপির শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মওদুত হাওলাদার টিবিএসকে বলেন, 'পান্থকুঞ্জ পার্কটিকে ঘিরে নানা অপকর্ম ঘটে যে বিষয়টি আমাদেরও বিব্রত করে। আমরা সিটি কর্পোরেশনকে লাইট দেওয়ার জন্য বারবার বলে আসছি। এখন ওখানকার অপরাধীদের সাথে আমাদের একপ্রকার চোর-পুলিশের খেলাই চলে।'
পুলিশের একটি মোবাইল টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে প্রতিনিয়তই ওখানকার ঘটনাগুলোর অভিযোগ আসে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করি যাতে এ অপরাধ না ঘটে। আমরা মাঝে অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছি।'
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ আবু নাছের টিবিএসকে বলেন, 'পান্থকুঞ্জ পার্কটির কাজ শুরু হলেও ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের খুঁটি পড়বে পার্কের ভিতর- এমন সিদ্ধান্তের কারণে কাজ বন্ধ রাখতে হয়। সর্বশেষ দক্ষিণ সিটির সাথে খুঁটি বসানো নিয়ে আলোচনা হয়। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ১২টি খুঁটির জন্য পার্কের ভিতর জায়গা দিতে কিন্তু দক্ষিণের মেয়র তিনটি খুঁটি বসানোর অনুমতি দেয়। মেয়রের এ সিদ্ধান্ত না মেনে শেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পার্কের মধ্যে কোনো খুঁটি বসাতে দেওয়া হবে না, পার্কের উন্নয়ন কাজ করা হবে।'
এ বিষয়ে গত ২০ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে পান্থকুঞ্জ পার্ক ১০ বছর ধরে বন্ধ করে রেখেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে তো ঢাকার মধ্যে নামার কথা না। পার্কের বারোটা কলাম দিয়ে নষ্ট করে চলে যাবে, সেজন্য সেটা বন্ধ করে দিয়েছি।'
শীঘ্রই পার্কটির উন্নয়ন কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ।