কানাডায় চাকরির ১০ লাখ শূন্যপদ থেকে বাংলাদেশ কি সুবিধা নিতে পারবে?
কানাডায় কর্মক্ষেত্রে শূন্যপদের হার বেশি থাকায় দেশটি বিপুল সংখ্যক অভিবাসীকে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। সাম্প্রতিক সব প্রতিবেদন অনুযায়ী উত্তর আমেরিকার দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের সামনে একটি ভালো সুযোগ রয়েছে।
তবে কানাডা স্থায়ী বসবাসের জন্য দক্ষ কর্মী ও পেশাজীবীদের প্রাধান্য দিলেও বাংলাদেশে দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে।
অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এই সুযোগগুলো কাজে লাগাতে দক্ষ কর্মী বিকাশে বাংলাদেশকে আরও জোরালোভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
কানাডায় যেসব খাতে কর্মীদের উচ্চ চাহিদা রয়েছে, সেগুলো হলো- স্বাস্থ্যসেবা, বাসস্থান, খাদ্য পরিষেবা, নির্মাণ, খুচরা বা রিটেইল বাণিজ্য, পরিবহন, গুদামজাতকরণ এবং শিক্ষাখাতের বিভিন্ন পরিষেবা।
কানাডার লেবার ফোর্স সার্ভে প্রতিবেদনে দেশটিতে শূন্যপদের উচ্চহারের পাশাপাশি বেকারত্বের নিম্নহারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, প্রতিবেদনটিতে বিভিন্ন খাতে ক্রমবর্ধমান জনশক্তির ঘাটতি ও বর্তমান কর্মীরা অবসরের বয়সে পৌঁছে যাওয়ায় অভিবাসনের প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধির বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন নিউজ ওয়েবসাইট সিআইসি নিউজ জানিয়েছে, দেশটির বেবি বুমার প্রজন্মের ৯০ লাখ কর্মজীবী এই দশকে অবসরের বয়সে পৌঁছাতে চলেছে। এদিকে দেশটির প্রজনন হার ২০২০ সালে রেকর্ড সর্বনিম্নতে নেমে এসেছে, যেখানে প্রত্যেক নারীর গড় প্রজনন হার ১.৪ শিশু। লেবার ফোর্স সার্ভে অনুসারে, বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ১০ লাখ চাকরির শূন্যপদ রয়েছে৷
কানাডা স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে দেশের বাইরে থেকে ২০২২ সালে ৪ লাখ ৩০ হাজার ও ২০২৪ সালে সাড়ে চার লাখেরও বেশি অভিবাসীকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে।
এক্সপ্রেস এন্ট্রি অ্যাপ্লিকেশন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা কানাডায় দক্ষ কর্মীদের প্রবেশের জন্য বেশ জনপ্রিয় পন্থা যার মাধ্যমে একজন প্রার্থীর যোগ্যতা মূল্যায়নের পাশাপাশি অন্যান্য প্রার্থীদের সঙ্গে তার র্যাংকিং করা হয়।
কম্প্রিহেনসিভ র্যাঙ্কিং সিস্টেম (সিআরএস)-এর ভিত্তিতে প্রার্থীদের র্যাঙ্কিং করা হয়। এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রার্থীরা স্থায়ী বসবাসের জন্য যোগ্য কিনা তা ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাদের প্রোফাইল ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা (আইআরসিসি) ওয়েবসাইটে আপলোড করলে তাদের একটি নাম্বার দেওয়া হয় যা সিআরএস স্কোর নামে পরিচিত।
ইমিগ্রেশন কনসালটেন্সি ফার্ম ভিসা এইডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, 'এই স্কোরটি শিক্ষা, ভাষার ক্ষমতা, কাজের অভিজ্ঞতা ও বয়সের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়। সিআরএস স্কোর যত বেশি হবে, একজন প্রার্থীর স্থায়ীভাবে বসবাসের আবেদন (আইটিএ) পাওয়ার সম্ভাবনা ততো বেশি।'
'অনেক বাংলাদেশি কানাডায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে ইচ্ছুক, কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই প্রয়োজনীয় যোগ্যতা নেই। গত মাসে অন্তত ১৫ জন অভিবাসন প্রত্যাশী আমাদের ফার্মে এসেছিলেন, কিন্তু তাদের কারোরই আবেদন করার মতো পর্যাপ্ত যোগ্যতা ছিল না,' বলেন তিনি।
কানাডার রিচমন্ডে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সিতে কর্মরত রাজিবুল রাজিব টিবিএসকে বলেন, 'কানাডা তাদের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখার জন্য অনেক দক্ষ কর্মীদের স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ দিচ্ছে। এই সুযোগগুলোর বেশিরভাগই চীন ও ভারতের লোকেরা নিয়ে নিচ্ছে'।
'আইএলটিএস-এ উচ্চ স্কোরসহ বিভিন্ন কঠিন শর্তের কারণে বাংলাদেশিরা এই সুযোগ সহজে নিতে পারছে না। তবে আপনি যদি একজন শিক্ষার্থী হিসেবে কানাডায় আসেন, তবে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনুমতি পাওয়া তুলনামূলকভাবে সহজ হবে।'
'শিক্ষার্থীরা দুই থেকে তিন বছরের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। অন্যদিকে এক বছর কাজ করার পর অভিবাসীরা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবেদন করতে পারেন,' বলেন তিনি।
কানাডায় বাংলাদেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম উল্লেখ করে রাজিবুল বলেন, 'ভারতে শিক্ষা ঋণ পাওয়া খুবই সহজ, যা বাংলাদেশে বেশ কঠিন। সরকারের উচিত এদিকে নজর দেওয়া। স্টুডেন্ট লোন পাওয়া সহজ হলে আমাদের অনেক শিক্ষার্থী কানাডায় যেতে পারবে।'
কানাডার স্বাস্থ্যখাতে বাড়ছে শূন্যপদ
লেবার ফোর্স সার্ভে অনুসারে, স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক পরিষেবা খাতে কানাডায় শূন্যপদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। এখানে প্রায় এক লাখ ৪৩ হাজার পদ শূন্য যা মোট খাতের প্রায় ৬ দশমিক ১ শতাংশ।
স্ট্যাটিস্টিকস কানাডার মতে, চলতি বছরের জুলাই মাসে পাঁচজন নার্সের মধ্যে একজনের বেশি নার্স বেতনসহ ওভারটাইমে কাজ করেছেন। ১৯৯৭ সাল থেকে বিদ্যমান তথ্যের সঙ্গে তুলনা করলে এই হার বর্তমানে সর্বোচ্চ।
২০২২ সালের জব ভ্যাকেন্সি অ্যান্ড ওয়েজ সার্ভের প্রথম ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কানাডায় ২৩ হাজার ৬২০টি শূন্য নার্সিং পদ আছে।
বাংলাদেশ সম্প্রতি কুয়েতে স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো শুরু করেছে এবং ইতোমধ্যে উপসাগরীয় দেশটিতে এক হাজার নার্স পাঠিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কানাডায় স্বাস্থ্যখাতের কর্মী পাঠানোর জন্য কর্তৃপক্ষের এখন যথাযথ উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
রিফিউজি এবং মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার ড. তাসনিম সিদ্দিকী টিবিএসকে জানান, 'বাংলাদেশ বর্তমানে বেশ সীমিত পরিসরে বিভিন্ন দেশে নার্সদের পাঠিয়ে থাকে। আমরা যদি কানাডাসহ উন্নত দেশে স্বাস্থ্যকর্মী সরবরাহ করতে পারি, তাহলে রেমিটেন্সের প্রবাহ অনেক বেড়ে যাবে'।
শিল্পখাতে শ্রমিক ঘাটতি বাড়ছে
কানাডার নোভা স্কটিয়া ও ম্যানিটোবা উভয় প্রদেশেই মে মাসে কর্মখাতে শূন্যস্থানের হার ছিল ১০ শতাংশের বেশি। বিশেষত আবাসন ও খাদ্য পরিষেবা খাতে এক লাখ ৬১ হাজারের বেশি শূন্যপদ রয়েছে।
টানা ১৩ তম মাসে সেখানে আবাসন ও খাদ্য পরিষেবা খাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক শূন্যপদ রয়েছে।
এছাড়া সব শিল্পখাতেই নির্মাণকাজে জনবলের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২১ সালের জুলাইয়ের পর চলতি বছরের মে মাসে ১৭ হাজার ৫০০টি পদ খালি হয়।
অন্টারিওতে নির্মাণ খাতে জনবল কমায় কর্মসংস্থান প্রায় দুই তৃতীয়াংশ পর্যন্ত হ্রাস পেয়েছে।
অন্টারিও সেখানকার রিটেইল বাণিজ্য খাতের কর্মসংস্থানেও বড় ধরনের হ্রাসের কথা জানিয়েছে।
পেশাগত, বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত পরিষেবাসহ পরিবহন, গুদামজাতকরণ, অর্থ ও বীমা, বিনোদন ও রিয়েল এস্টেটেও চাকরির শূন্যপদ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।