চা বিক্রি থেকে বগুড়ার সেরা দইয়ের দোকান হয়ে ওঠা ‘এশিয়া সুইটস’
চিকিৎসক বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেরাও তার পথে হাঁটবেন। কিন্তু তা হয়নি। তিন ছেলে হতে চেয়েছিলেন খেলোয়াড়। জেলাজুড়ে সুনাম অর্জনও করেছিলেন। কিন্তু জাতীয় দলে খেলা হয়নি। পরে জীবনযুদ্ধে তাদের অভিধানের নতুন গল্প রচিত হয় চা বিক্রিকে ঘিরে। তবে এ ব্যবসাতেও স্থায়ী হওয়া যায়নি সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে। পরে তারা নামেন দই ব্যবসায়। 'দইয়ের রাজধানী' খ্যাত বগুড়ায় তারাই এখন শীর্ষে।
গল্পটা বগুড়ার এশিয়া সুইটসের। ১৯৮৫ সাল থেকে গড়ে তোলা এই প্রতিষ্ঠান বগুড়ায় সুনামের সাথে ব্যবসা করে চলেছে। সুনাম ধরে রেখে এই ব্যবসা আরও তারা চালিয়ে যেতে চান। ২০০ শ্রমিক নিয়ে চলমান এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ১০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের আশা জাগাচ্ছে।
এশিয়া প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১ হাজার কেজি দই উৎপাদন করে। তবে 'দইয়ের রাজধানী' হিসেবে পরিচিত বগুড়ায় মোট কী পরিমাণ দই উৎপাদন হয়, তার কোনো সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, লোকমুখে শোনা যায় বগুড়ার শেরপুরের ঘেটু ঘোষের হাতে তৈরি হয়েছিল প্রথম দই। এখন ছোট-বড় মিলে এখন অন্তত ৪০০ কারখানায় দই উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন গড়ে তৈরি হয় প্রায় ৫০ টন। উৎসব কিংবা দুই ঈদে এ চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। তখনও কদর সবচেয়ে বেশি এশিয়ার।
এশিয়া সুইটস গড়ে তোলার পেছনে মো. নুরুল বাশার চন্দন, নুরুল আলম টুটুল ও নুরুল হুদা তিলক এই তিন ভাইয়ের ভূমিকা রয়েছে।
তাদের বাবা নুরুল হক চিকিৎসক ছিলেন। দাদাও আজীবন চিকিৎসক হিসাবে মানুষের সেবা করে গেছেন। তবে বাস্তবতার ভিন্ন সমীকরণে আটকে যায় টুটুল, তিলক আর চন্দন। তাদের তিন বোনদের মধ্যেও ডাক্তার নেই কেউ। তাদের কেউ কবি, কেউ আবৃত্তিকার কেউবা সঙ্গীতচর্চা করেন।
আশির দশকে বাংলাদেশ ভলিবল টিমের খেলোয়াড় ছিলেন টুটল। তিলকও জেলা পর্যায়ে ভলিবল খেলতেন। তবে চন্দনের টান ছিল ফুটবলে। জেলা পর্যায়ে তিনিও ভালো ফুটবল খেলতেন। তবে ক্যারিয়ার হিসেবে তারা খেলা ছেড়ে বেছে নিলেন ব্যবসাকে।
টুটুল ও তিলকের হাত ধরে ১৯৮৫ সালের দিকে মূলত ছোট আকারে হোটেল ব্যবসা শুরু হয়। শহরের কাজী নজরুল ইসলাম সড়কের পাশে সাড়ে তিন শতকের যে দোকানে বাবা নুরুল হক চিকিৎসা দিতেন তার একপাশেই গড়ে তোলা হয় হোটেল। এখানে শুরুর দিকে লুচি, সবজি, সমুচা, সিঙ্গারা ও মিষ্টি বিক্রি শুরু করে্ন তারা। এক বছরের মধ্যেই গরুর দুধের চা বিক্রি করে শহরজুড়ে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন তারা। ওই সময়ে এশিয়া সুইটসের এক কাপ চায়ের জন্য লোকজন দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করে থাকতেন।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সুশাসনের জন্য নাগরিক বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক তুহিনুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান, 'এশিয়া তো চা বিক্রি করেই মানুষের কাছে প্রথমে পরিচিতি পেয়েছে। তাদের চা খাওয়ার জন্য অন্য জেলা থেকেও লোকজন আসতেন। বগুড়ার প্রবীণ সব লোকই বিষয়টি জানেন। অনেকে এক কাপ চা খেয়ে ১ হাজার টাকার নোট দিতেন। এ কারণে তারা বিব্রতও হতেন। পরে বাধ্য হয়ে তারা দই-মিষ্টি বিক্রি শুরু করেন। এখন তাদের দই নেওয়ার জন্য মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এখন বগুড়ার দইয়ে এশিয়াই সেরা।'
বর্তমানে এশিয়া সুইটস দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছেন অন্যতম পরিচালক মো. নুরুল বাশার চন্দন। তিনি জানান, 'আমাদের হোটেলে মূলত চা-নাশতার ব্যবস্থা ছিল। যেকোনো নাশতা খাওয়ার পর আমাদের দেশের মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য হলো চা খাওয়া। আমাদের এখানে গরুর খাঁটি দুধের চায়ের বেশ চাহিদা তৈরি হলো।"
কিন্তু সে সময় কিছু লোকের আচরণগত অবক্ষয়ে বিরক্ত হয়ে চা বিক্রি বন্ধ করে দেন তারা।
এরপর বহুমুখী চিন্তা করে দই উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় আসে। চন্দন বলেন, 'বগুড়ায় তো কয়েকশ বছর ধরে দই উৎপাদন হচ্ছে, তাহলে আমাদের দই কেন মানুষ কিনবে? এই বিষয়টি নিয়ে চিন্তা শুরু হয়। প্রথমে আমরা সিদ্ধান্ত নেই সবচেয়ে ভালো মানের দই উৎপাদন করব। এই চিন্তা থেকেই ভালো কারিগর খোঁজা শুরু হয়। একপর্যায়ে বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলা থেকে ভালো কারিগর খুঁজে বের করা হয়।'
অবশেষে ২০০৬ সালের দিকে কারিগর রিয়াজ কবিরাজের হাত ধরে এশিয়া দই উৎপাদন শুরু করে। তখন অবশ্য বগুড়ায় দইয়ে প্রসিদ্ধ ছিল মহরম, গৌর গোপালের মতো দোকানীরা।
চন্দন বলেন, 'আমরা দই উৎপাদনের কিছুদিনের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পাওয়া শুরু করি। এরপর ধীরে ধীরে আমাদের দইয়ের ব্যবসা বিকশিত হতে থাকে। এর মধ্যে লুচি, সিঙ্গারা, সমুচাসহ নাশতার আইটেমগুলো উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করে দেওয়া হয়।'
ব্যবসা কম করে সুনাম অক্ষুণ্ণ রাখার স্লোগানে চলা এশিয়া সুইটসের দই ও মিষ্টির চাহিদা এখন দেশজুড়ে। এখানে কোন 'বাসি' দই বা মিষ্টি বিক্রি করা হয় না। কারণ তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হয়ে যায় দুপুরের মধ্যেই।
এশিয়ার দই কিংবা মিষ্টির চাহিদা যতই থাকুন না কেন তারা এখন নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি উৎপাদন করেন না। কারণ এতে তাদের মান কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
কেন এই আশঙ্কা জানতে চাইলে চন্দন বলেন, 'এখন গরুর দুধের ব্যাপক সংকট। সরবরাহও কম। তার ওপর ভালো মানের দুধ পাওয়া যায় না। ১০ বছর আগে একমণ দুধ থেকে ৮ কেজির উপরে ছানা পাওয়া যেতো। এখন সেখানে ৬ কেজি পাওয়া কঠিন। এক মণ দুধে এখন ৮ থেকে ১০ কেজি পানি মেশানো থাকে। সব জেনেও বাধ্য হয়ে কিনতে হয়। দুধের সংকটের কারণে আমরা বেশি দই-মিষ্টি উৎপাদন করতে পারি না।'
এশিয়াতে প্রতিদিন অন্তত ৬০ মণ দুধ লাগে। একই সঙ্গে ২৫০ থেকে ৩০০ কেজি ছানার প্রয়োজন হয়। দুধের সাথে বাজারে ছানাতেও ব্যাপক ভেজাল বলে জানান চন্দন। এশিয়া সুইটসে এক মণ দুধ থেকে এখন ২০ থেকে ২১টি দইয়ের সরা (দই রাখার পাত্র) তৈরি করা হয়। প্রতিটি সরাতে দই থাকে সাড়ে ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম। দাম ২৬০ টাকা করে। এই দই গরমের সময় ২৪ এবং শীতে ৪৮ ঘণ্টা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায়।
সরকারি হিসাবে সারা দেশে এখন ৪৬ লাখ টন দুধের ঘাটতি আছে উল্লেখ করে নুরুল বাশার চন্দন বলেন, 'এশিয়াতে প্রতিদিন আরও ৫০ মণ দুধের পণ্যের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু ভালো দুধের যোগান নেই। ভালো দুধের যোগান দিয়ে বগুড়ায় আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর চালু করলে আমরাই অন্তত ১০ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব।'
চন্দন বলেন, 'বাবা একসময় চাইতেন আমাদের মধ্যে কেউ চিকিৎসক হবেন। কিন্তু আমরা ৬ ভাইবোন কেউ সে পেশায় আসতে পারিনি। তবে এ নিয়ে বাবার কোন আক্ষেপ ছিল না। বাবা চাইতেন তার ছেলেমেয়েরা যা করবে, সেটা যেন সততার সাথে ভালোভাবে করে। বাবা আমাদের সুনাম দেখে খুশিই ছিলেন।'
বগুড়ার চেলোপাড়ার বাসিন্দা শাজাহান আলী বলেন, 'সততা, পণ্যের মান, ওজনে ঠিক দেওয়া সবশেষে স্বাদে অনন্যতার কারণে এশিয়া বগুড়ায় দইয়ের সাম্রাজ্যে প্রধান সেনাপতি হিসেবে অবস্থান করছে। বেশি উৎপাদনের দিক থেকে নয়, গুণগত মানে এশিয়া দই-ই সেরা।'
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি মাহফুজুল ইসলাম রাজ বলেন, 'সমগ্র বিশ্বের দইয়ে বগুড়া যেমন সেরা, তেমনই বগুড়ার দইয়ের রাজ্যের রাজা এশিয়া সুইটস।'
জেলা চেম্বারের সহ-সভাপতি আরও বলেন, 'ব্যবসায়িক সৌহার্দ্য বাড়াতে ২০০৯ সালের দিকে ভারতের শিলিগুড়িতে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে দই পাঠানো হয়। দই স্বাভাবিকভাবে অল্প সময় সংরক্ষণ করা যায় বলে বগুড়া থেকে রপ্তানি করা কঠিন। মূলত বিভিন্ন ব্যবসায়িক কারণেই বগুড়ায় আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দর চালু করা দরকার।'