ডিজেলের কর কমল, এখন দাম কমার অপেক্ষা
পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষ জেরবার। তাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নিত্যপণ্য ডিজেল ও চাল আমদানিতে ১০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কমিয়েছে সরকার।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ আজ রোববার এ-সংক্রান্ত দুটি পৃথক নির্দেশনা জারি করেছে।
আমদানি শুল্ক হ্রাসের পর ডিজেলের আমদানি শুল্ক ২২.৭৫ নেমে এসেছে। আর চালের আমদানি শুল্ক নেমে এসেছে ১৫.২৫ শতাংশে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যুগুলোর একটি জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। এই মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইতিমধ্যে মূল্যস্ফীতির হার আরও বেড়ে গেছে। এর জেরে মানুষ পড়েছে চরম দুর্ভোগে। মানুষকে স্বস্তি দেওয়ার লক্ষ্যে ডিজেলের আমদানিতে সরকার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কর কমিয়েছে, পুরো জ্বালানি তেলের মধ্যে যার ব্যবহার প্রায় ৭৩ শতাংশ।
কর হ্রাসের ফলে ডিজেলনির্ভর পরিবহন, সেচসহ অন্যান্য সেবায় ব্যয় কমার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে ডিজেলের দাম বাড়ায় ইতিমধ্যেই যেসব সেবা ও পণ্যের দাম বেড়েছে, তা কতটুকু কমবে কিংবা কমলেও তা আমদানি ব্যয় হ্রাসের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
তবে পেট্রোল, অকটেনের মতো অন্যান্য জ্বালানি তেলের আমদানি কর কমানো হয়নি। সে কারণে পেট্রোল ও অকটেনচালিত গাড়ি কর হ্রাসের সুবিধা পাবে না।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'ডিজেলের দাম কমানের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি আমরা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়ে সরকার সিন্ধান্ত নেবে। সরকার থেকে নির্দেশনা এলে বিপিসির দিক থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
গত ৬ আগস্ট সরকার জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়ানোর পর বিষয়টি নিয়ে দেশব্যাপী তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হলে সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে জ্বালানির দাম কমানোর আশ্বাস দেওয়া হয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীও বিশ্ববাজারে জ্বালাানির দাম কমলে দেশের বাজারে দাম কমানোর আশ্বাস দেন।
এদিকে চাল আমদানিতে নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক ১০ শতাংশ কমানোর ফলে প্রতি কেজি চালের দাম প্রায় ৩ টাকা কমতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ অটো মেজর হাস্কিং মিল ওউনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শহীদুর রহমান পাটওয়ারি। এর ফলে স্থানীয় পর্যায়ে চাল ও ধানের দামও প্রায় ৩ টাকা করে কমবে বলে জানান তিনি টিবিএসকে।
ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া গণপরিবহনসহ সব ধরনের পণ্যবাহী পরিবহন ডিজেল ব্যবহার করে পরিচালিত হয়। ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে ওইসব পরিবহনের ভাড়া বেড়েছে। এর ফলে বেড়েছে প্রায় সব ধরনের পণ্যমূল্য।
যেমন আমদানি-রপ্তানি পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সঙ্গে জড়িত কনটেইনার ডিপোগুলো ইতিমধ্যে রপ্তানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ ও আমদানির ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে। নতুন করে ডিজেলের কর কমানোর ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, তারা এই ভাড়া কমাবে কি না।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ টিবিএসকে বলেন, সরকার কর কমিয়েছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই আইসিডিগুলোর উচিত হবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ কমানো।
'এ বিষয়ে শিগগিরই আমরা তাদের চিঠি দেব,' বলেন তিনি।
আইসিডি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সাধারণ সম্পাদক রুহুল আমিন শিকদার টিবিএসকে বলেন, সরকার তেলের দাম লিটারপ্রতি কত টাকা কমাবে তার ওপর নির্ভর করতে আইসিডির চার্জ কতটুকু কমবে।
তিনি আরও বলেন, 'আইসিডি চার্জ কমানোর কতটুকু সক্ষমতা আছে, আইসিডি মালিকদের সেটিও বিবেচনায় রাখতে হবে। কারণ ৪২ শতাংশ ডিজেলের দাম বৃদ্ধি হলেও বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করতে একই পরিমাণ চার্জ আমরা বৃদ্ধি করতে পারিনি।'
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান টিবিএসকে বলেন, সরকার যেহেতু আমদানিতে কর কমিয়েছে, তাই বিপিসির উচিত ডিজেলের দাম কমানো। তা না হলে গ্রাহক পর্যায়ে কর হ্রাসের কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না।
৫ আগস্ট জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ যখন ডিজেলের দাম ৪২.৫ শতাংশ এবং অকটেনের দাম ৫১ শতাংশ বাড়ায়, তখন বিপিসি চেয়ারম্যান এবিএম আজাদ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, বিপিসি প্রতি লিটার অকটেন ও পেট্রোলে ২৫ টাকা লাভ করছে, আর প্রতি লিটার ডিজেলে ৬ টাকা লোকসান দিচ্ছে।
ওই সময় প্রতি ব্যারেল ডিজেলের প্ল্যাটস রেট ছিল ১২৪.৬৩ ডলার, যা এখন ব্যারেলপ্রতি ১৪৭ ডলার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিসির কয়েকজন কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানিয়েছেন, প্রতি ব্যারেল ডিজেলের প্ল্যাটস রেট ১১৮ ডলারে নেমে এলেও কর্পোরেশন 'ব্রেক-ইভেনে' আসবে।
তারা বলেন, 'অকটেন ও পেট্রোলে কিছুটা লাভ হলেও সর্বশেষ মূল্যবৃদ্ধির পরও বিপিসি লোকসান দিচ্ছে, কারণ দেশে মোট ব্যবহৃত জ্বালানি তেলের ৭২ শতাংশই ডিজেল।'
সরকার প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, প্রতি লিটার অকটেনের দাম ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা এবং প্রতি লিটার পেট্রোলের দাম ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কেরোসিনের দামও ৪২.৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়েছে।
বর্তমানে তরল জ্বালানি আমদানিতে প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। এছাড়া বিতরণ পর্যায়ে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ এবং ব্যবসায়িক পর্যায়ে আরও ২.৫ শতাংশ আদায় করা হয়।
এই কর ব্যবস্থার আওতায় সরকার প্রতি বছর তরল জ্বালানি খাত থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা এবং এর চেয়েও বেশি রাজস্ব আয় করে।
এনবিআরের তথ্যানুসারে, সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৫ হাজার ৬২ কোটি টাকার পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির আমদানি আমদানি শুল্ক বাবদ ১১ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা পেয়েছে।
কর্পোরেশনের বাজেট প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ সালে জাতীয় কোষাগারে বিপিসি যথাক্রমে ১৪ হাজার ১২৩ কোটি ও ১৫ হাজার ৪৬ কোটি টাকা দিয়েছে।
এর ওপরে বিদ্যমান মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতিতে বিভিন্ন চার্জ আকারে প্রতি লিটার জ্বালানির দামে অতিরিক্ত ৫.২ টাকা যোগ করা হয়।