অপ্রস্তুত লিংক রোড, বঙ্গবন্ধু টানেল খুলে দেওয়ার পর যানজটের আশঙ্কা
অক্টোবরের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু টানেল বা কর্ণফুলী টানেলের দুইটি টিউবের একটি যান চলাচলের উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। ডিসেম্বরেই টানেলটি পুরোপুরি চালু করার লক্ষ্য রয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ি টানেলে প্রথম বছরেই অন্তত ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করবে। কিন্তু অপ্রস্তুত সংযোগ সড়কগুলোর কারণে টানেলের সুফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরী হয়েছে।
শুধু তাই নয়, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) সমস্যা সমাধানে কিছু ফ্লাইওভার ও ইউলুপ তৈরীর পরিকল্পনা করেছে। যা অনুমোদনের জন্য একনেকে পাঠানো হবে। তবে সিডিএর এই পরিকল্পনা কবে শেষ হবে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ।
সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ মনে করে, সড়ক ব্যবস্থপনা ঠিক না করে টানেল খুলে দিলে যে যানজট তৈরী হবে তা হবে ভয়ঙ্কর।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যান চলাচল শুরুর আগে বঙ্গবন্ধু টানেলে দুই পাড়ের প্রধান সড়ক ও ফিডার রোড গুলো পরিকল্পনা অনুযায়ি তৈরী ও চালু করা না গেলে টানেলকে ঘিরে যানজট শুরু হবে, আসবেনা সুফল।
এসব সড়ক টানেলের কাজ শেষ করার আগে করার কথা থাকলেও তা না হওয়ায় তারা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু টানেলের সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, টানেলের যোগাযোগ সুষ্ঠু করার লক্ষে নগরের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট পর্যন্ত চারলেনের সড়ক তৈরী, আনোয়ারা প্রান্তের পিবি সড়ক ও আনোয়ারা-বাঁশখালী সড়ককে যথাক্রমে ছয় ও চার লেনে উন্নীত করা, টানেল থেকে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশের জন্য আউটার রিংরোড রোড থেকে তিনটি ফিডার রোড (সংযোগ সড়ক) চালুসহ একাধিক উদ্যোগের কথা।
কিন্তু টানেল চালুর মাত্র এক মাস বাকি থাকলেও এসব কাজের কোনোটাই এখনো শেষ হয়নি। এ অবস্থায় টানেল চালু হলে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে 'বটল নেকিং' সমস্যার তৈরী হবে। যে কারনে তীব্র যানজটসহ সড়ক দুর্ঘটনার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশিদ রোববার (২১ অক্টোবর) টিবিএসকে বলেন, "জুন পর্যন্ত আমাদের প্রকল্পের ৮৮ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি ১১ দশমিক ৫ শতাংশ কাজ ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার চেষ্টায় আছি; তবে আমাদের হাতে আগামী জুন পর্যন্ত সময় আছে।"
পতেঙ্গা প্রান্তের অব্যবস্থাপনা টানেলের সুফলকে দীর্ঘায়িত করবে
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক (বন্দর) বিভাগের উপ-কমিশনার তারেক আহমেদ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান- টানেলের উত্তর প্রান্তের আউটাররিংরোড, কাটগড়সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, এয়ারপোর্টমুখীসড়ক, পতেঙ্গা সৈকতমুখী সড়ক এবং টানেলের প্রবেশ পথ মিলিত হয়েছে।
তিনি বলেন, 'টানেলের উত্তর প্রান্তের প্রবেশ মুখে পাঁচটি সড়ক মিলিত হয়ে যে যানজট পরিস্থিতি তৈরী হবে তা ভয়ঙ্কর। এছাড়া ওই জংশনের আধ কিলোমিটারের মধ্যে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। এ অবস্থায় বিপুল গাড়ির চাপ ও জনচাপ কিভাবে সামলানো হবে এ নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করা হয়েছে কিনা তা আমাদের জানা নেই। সিডিএ তাদের পরিকল্পনার কথা বলছে, তবে তা কখন বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে আমরা সন্দিহান।'
তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস জানান, পতেঙ্গা ইন্টার সেকশনের যানজট সমস্যা কাটাতে সিডিএ কয়েকটি ফ্লাইওভার ও ইউলুপের পরিকল্পনা করেছে।
'আশা করছি এসব বাস্তবায়ন হলে আগামী অন্তত পাঁচ বছর আমরা সমস্যামুক্ত থাকতে পারবো', বলেন কাজী হাসান বিন শামস।
আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার বলেন, 'যারা টানেল ব্যবহার করবেন তারা মূলত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌছানোর জন্য করবেন। এখন যদি টানেলের প্রবেশ পথে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে নাগরিকরা টানেলের সুফল পাবো না। একই সাথে গাড়ি চালকরা টানেল ব্যবহারে উৎসাহ হারাবেন।'
অপরিকল্পিত আউটার রিং রোডে ভয়াবহ যানজট ও দুর্ঘটনার শঙ্কা
বঙ্গবন্ধু টানেলের সাথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে যুক্ত করেছে সাগরপাড়ের আউটার রিং রোড। ১৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার দূরত্বের রিং রোডের ছয় কিলোমিটার অংশ মাত্র দুই লেনের। বিশেষ করে সাগরিকা পয়েন্ট থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত সড়কের চওড়া দুই লেন হওয়ায় এবং ফিডার রোড গুলো চালু না হওয়ায় টানেলের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। ট্রাফিক বিভাগ বলছে, এ অব্যবস্থাপনার কারনে রিং রোডের সাগরিকা পয়েন্টে সৃষ্ট হতে পারে দীর্ঘজটের; শঙ্কা রয়েছে বড় দুর্ঘটনার।
সিএমপির উপ-কমিশনার তারেক আহমেদ বলেন, 'টানেল পার হয়ে গাড়ি গুলো চারলেনের রিংরোড হয়ে সড়কের রাসমনি ঘাটের কাছে এসে মিলিত হবে দুই লেনের টোল রোডে। যেটা দিয় চট্টগ্রাম বন্দর ও বেসরকারি কনটেইনার ডিপোর মালামালবাহী প্রাইমমুভার, ট্রাক এবং কাভার্ডভ্যান গুলোও ট্রাঙ্ক রোডে উঠবে। এতে ছয় লেনের গাড়িগুলোকে চলাচল করতে হবে দুই লেনের সড়ক দিয়ে। এটি যানজট ও দুর্ঘটনার কারণ হয়ে উঠবে।'
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, 'আগামীতে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল ও বে-টার্মিনালের চালু হলে টোল রোড ও লিংক-রোডে গাড়ির চাপ বৃদ্ধি পাবে পাঁচগুনেরও বেশি। এতে সাগরিকা থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় যানজট প্রকট আকার ধারণ করবে।'
সওজ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, 'আউটার রিং রোডের পরের অংশটি ছয় লেন করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া টোল রোডটিকে ছয়লেন করার জন্য ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে। সরকারের ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের কমিটির অনুমোদনের পর কার্যাদেশ দিতে প্রায় দুই বছরের বেশি সময় লাগবে।'
ইঞ্জিনিয়ার দেলোয়ার মজুমদার বলেন, 'টানেল তৈরী করা হয়েছে ঢাকা থেকে কক্সবাজারের দুরত্ব কমাতে। কিন্তু টানেলগামী আউটার রিং-রোড ও টোল রোড প্রসস্থকরণসহ বাকি কাজ গুলো না গুছিয়ে যদি টানেল চালু করা হয়, তবে এই সংকটটি থেকে যাবে।'
ফিডার রোডে অভাবে বাড়ছে দুর্ভোগ
নগরবাসীকে সিটি আউটার রিং রোড ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তিনটি ফিডার রোড (সংযোগ সড়ক) চালুর কথা ছিলো। তবে চারবার মেয়াদ বাড়িয়েও প্রস্তাবিত তিনটি ফিডার রোডের (সংযোগ সড়ক) একটিরও নির্মাণ কাজ শেষ করতে পারেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
ফলে চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দাদের টানেলের সুবিধা পেতে হলে প্রায় ১০ কিলোমিটার ঘুড়ে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সড়ক ঘুরে আউটার রিং রোডে উঠতে হবে। পতেঙ্গা সৈকত কিংবা বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথেও দীর্ঘপথে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নগরবাসীকে।
সওজ চট্টগ্রাম জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, 'রেলওয়ের বাঁধার কারনে সাগরিকা পয়েন্টে ও ওয়াসার আপত্তির কারণে আনন্দবাজার এলাকার ফিডার রোড গুলো হচ্ছেনা।'
নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, 'প্রকল্পটি একেবারেই অপরিকল্পিত। টানেল থেকে মানুষ গুলো কিভাবে শহরে যাবে একটা গবেষণার বিষয়। আউটার রিংরোড দিয়ে গেলেও তারা কোথায় গিয়ে রাউট টার্ণ নিবে, কোথায় যাবে তার কোনো প্ল্যানিং নাই।'
টানেলের কারণে খুলবে ৮ কিমি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, লাভ কি ?
বঙ্গবন্ধু টানেল থেকে চট্টগ্রাম নগরে প্রবেশে অন্যতম প্রধান পথ বিবেচনা করা হচ্ছে নির্মানাধীন এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েকে। তাই ৩৫ শতাংশ কাজ বাকি রেখে ফেব্রুয়ারিতে এক্সপ্রেসওয়ের ৮ কিলোমিটার অংশ চালুর কথা বলছে চট্টগ্রাম উন্নয়ণ কর্তৃপক্ষ।
প্রকল্প পরিচালক মাহফুজুর রহমান বলেন, 'ফেব্রুয়ারির মধ্যে সল্টগোলা থেকে নিমতলা বিশ্বরোড পর্যন্ত আট কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ হবে। এতে টানেল থেকে শহরমূখী গাড়িগুলো নিমতলা দিয়ে পোর্ট কানেকটিং রোডের সাথে যুক্ত হতে পারবে।'
তবে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, 'এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নকশায় নিমতলা দিয়ে শুধু নামা যাবে, ওঠার সুযোগ নেই। তাই পোর্ট কানেকটিং রোড দিয়ে কেউ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে পারবে না।'
নগরপরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, 'এক্সপ্রেসওয়ে যেখানে নামানো হবে সেটি পোর্ট কানেকটিং রোড। সেটি দিয়ে প্রতিদিন ১০ হাজার গাড়ি বন্দরে যাতাযাত করে। আশপাশে আরও চারটি কনটেইনার ডিপো আছে। এক্সপ্রেসওয়ে থেকে নেমে আসা গাড়ি গুলো কোথায় যাবে আর বন্দরের গাড়ি গুলোইবা কোথায় যাবে? এ পুরো বিষয়টাই হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরী হবে।'
আনোয়ারা-পেকুয়া সড়ক উন্নয়নে উদ্যোগ নেই
বঙ্গবন্ধু টানেলের সমিক্ষা প্রতিবেদনে, টানেলের সুফল কাজে লাগাতে আনোয়ারা প্রান্তের পিবি সড়ককে ছয়লেন ও আনোয়ারা- বাঁশখালী সড়ককে চারলেনে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু টানেল চালুর আর মাত্র দেড় মাস বাকি থাকলেও পিবি সড়কের কাজ এখনো শেষ হয়নি। কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি আনোয়ারা-পেকুয়া সড়ক উন্নয়নেরও।
স্থানীয় সমাজ কর্মী মোরশেদ নয়ন বলেন, 'বাঁশখালী সড়কের পাশেই গড়ে উঠছে চীনা ইকোনোমিক জোন; হচ্ছে কয়লা ভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্র। পাশেই পারকি সমুদ্রসৈকত। অন্যদিকে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ীতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, এলএনজি স্টেশনসহ বহুবিধ শিল্পকারখানা গড়ে উঠছে। আনোয়ারা থেকে কক্সবাজারের পেকুয়া পর্যন্ত সড়কটি চারলেন হলে টানেলের সক্ষমতাকে পূর্ণভাবে কাজে লাগানো যাবে।'
এ বিষয়ে সওজ চট্টগ্রাম জোনের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, 'পিবি সড়ককে ছয় লেন করার কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ শেষ। তবে আনোয়ারা- বাঁশখালী সড়ক উন্নয়নটি পরিকল্পনায় থাকলেও তা এখনই করা হচ্ছে না।'