৬ র্যাম্প নির্মাণ স্থগিতে চট্টগ্রামে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের যানজট নিরসনের লক্ষ্যে নগরীর প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে– শহীদ ওয়াসিম আকরাম ফ্লাইওভার– নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ র্যাম্প নির্মাণ স্থগিতের পাশাপাশি বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতায় উড়াল সড়কটির কার্যকারিতা নিয়ে এখন শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গত বছর চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এক্সপ্রেসওয়ের ১৫টির র্যাম্পের মধ্যে ৬টির নির্মাণ স্থগিত করে। এর ফলে ফ্লাইওভারটির কার্যকারিতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিভিন্ন পক্ষের বিরোধিতায় ব্যস্ততম জিইসি মোড়ের র্যাম্প নির্মাণ নিয়েও বেশ জটিলতার মুখে পড়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সমীক্ষা ছাড়া পর্যাপ্ত র্যাম্প নির্মাণ বাদ দিলে এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়েতে প্রবেশযোগ্যতা কমবে। ফলে প্রায় ৪,২৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নিমিত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সেতুর সুফল থেকে বঞ্চিত হবে মানুষ।
যদিও এর বিপরীতেও বিশেষজ্ঞ মত রয়েছে। কারণ র্যাম্প নির্মাণের নকশা প্রণয়নেও সাম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা অনুসরণ করা হয়নি।
সিডিএর তথ্যমতে, নগরীর লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সড়কের সংযোগ করতে আগ্রাবাদে ৪টি; টাইগারপাস, নিমতলা, সিইপিজেড ও কেইপিজেড এলাকায় ২টি করে এবং জিইসি মোড়, ফকিরহাট ও সিমেন্ট ক্রসিং মোড়ে ১টি করে মোট ১৫টি র্যাম্প (ওঠা-নামার) নির্মাণের কথা ছিল।
গত ২৮ অক্টোবর সিডিএর নবগঠিত বোর্ডের প্রথম সভায় যানজট বৃদ্ধির অজুহাতে ও ব্যয় সংকোচনে 'অপরিকল্পিত' উল্লেখ করে ৬টি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্থাটি।
র্যাম্প নির্মাণ স্থগিতের প্রভাব
বর্তমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, পতেঙ্গা থেকে লালখান বাজারমুখী ফ্লাইওভারে নিমতলা, টাইগারপাস (আমবাগান সড়কে) ও লালখান বাজারে নামার সুযোগ থাকবে। একইমুখী যাত্রীরা পতেঙ্গা ছাড়াও মধ্যপথে কেইপিজেড, সিইপিজেড, নিমতলা দিয়ে উঠতে পারবেন।
অন্যদিকে, লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গামুখী ফ্লাইওভারের আগে দুই নম্বর গেট ও মুরাদপুর আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভারে উঠে সরাসরি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠেতে পারবেন যাত্রীরা। এর বাইরে শুধু জিইসি ও আগ্রাবাদ ঢেবারপার র্যাম্প দিয়ে ওঠার ব্যবস্থা থাকবে। আর একইমুখী যাত্রীরা নামতে পারবেন ফকিরহাট, সিইপিজেড, আর পতেঙ্গায়।
নগরীর টাইগারপাসের মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী সড়কের পলোগ্রাউন্ড মূল সেতুতে ওঠার র্যাম্পটি নির্মাণ না করলে কোতোয়ালি, নিউমার্কেট, রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ, চকবাজার, সদরঘাট থেকে আসা যানবাহনগুলো ৬-৭ কিলোমিটার দূরে আগ্রাবাদ ঢেবারপাড় দিয়ে উঠতে হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। ফলে যানজট কমবে না। সুফল পাবে না মানুষ।
মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে আগ্রাবাদে জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের সামনে নামা ও আগ্রাবাদের অ্যাকসেস রোডে ওঠা-নামার দুটি; মোট তিনটি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিত করায় হালিশহর, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা, দেওয়ানহাট, ডবলমুরিং এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী সুফল থেকে বঞ্চিত হবেন। প্রকল্পটির সমীক্ষায় এই এলাকাটি গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
মূল এক্সপ্রেসওয়ে থেকে ইপিজেড নামার র্যাম্প না করলে শিল্প কারখানা সংশ্লিষ্টরাও বঞ্চিত হবেন সুফল থেকে। এছাড়া সিমেন্ট ক্রসিং এলাকায় নৌবাহিনীর জমিতে তাদের ব্যবহারের জন্য একটি প্রস্তাবিত র্যাম্প ছিল; সেটিও স্থগিত করা হয়েছে।
জিইসি র্যাম্পের বিরোধিতা
এদিকে, এবার জিইসি র্যাম্পের বিরোধিতা করেছেন সিটি করপোরেশনের মেয়র শাহাদাত হোসেনসহ শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা।
গত ১৮ ডিসেম্বর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন র্যাম্পটি নির্মাণ নিয়ে আপত্তি জানান।
মেয়রের অভিযোগ, জিইসি মোড়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান দি পেনিনসুলা হোটেলের যাত্রীদের সুবিধা দিতে র্যাম্প নির্মাণ করা হচ্ছে। এটি করতে দেওয়া হবে না।
যদিও সিডিএ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন— র্যাম্পটি নির্মাণে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও বিরোধিতা করেছিলেন। এজন্য সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যানের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতিও হয়।
জিইসি র্যাম্পটি না হলে নগরীর আখতারুজ্জামান চৌধুরী ফ্লাইওভারের বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক প্রান্ত ও মুরাদপুরের মোহাম্মদপুর প্রান্ত হয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠা ছাড়া বিকল্প পথ থাকবে না। ফলে খুলশী, পাহাড়তলী, নাছিরাবাদ এলাকার বিশাল জনগোষ্ঠী এক্সপ্রেসওয়ের সুফল থেকে বঞ্চিত হবে।
প্রকল্প পরিচালক ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান টিবিএসকে বলেন বলেন, "সিডিএ চেয়ারম্যান ও বোর্ড সদস্যরা যাচাই-বাছাই শেষে ছয়টি র্যাম্প নির্মাণ স্থগিতে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। ভবিষ্যতে চাইলে নির্মাণ করা যাবে। জিইসির র্যাম্পের নির্মাণকাজ বন্ধে কোনো নির্দেশনা পাইনি।"
কার্যকারিতা, সম্ভাব্যতা ও পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "র্যাম্প কম নির্মাণের ফলে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কার্যকারিতা থাকবে না। জিইসি মোড়ের র্যাম্প নির্মাণ না করলে আশেপাশের মানুষকে অনেক দূরে গিয়ে সেতুতে উঠতে হবে।"
চুয়েটের সাবেক উপাচার্য ও পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম টিবিএসকে বলেন, "এক্সপ্রেসওয়ে শুধু লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা যাওয়ার জন্য নয়। মানুষের দৈনন্দিন চলাচলের জন্য করা হয়েছে। নকশা অনুযায়ী র্যাম্পগুলো না থাকলে মানুষ সুফল পাবে না। নিচে যানজট থাকবে। পর্যাপ্ত ওঠা-নামার জায়গা না থাকলে গাড়ি কম চলবে। প্রত্যাশিত গাড়ি না পেলে নির্মাণ খরচ দূরে থাক, রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও তোলা কষ্টকর হবে। এটিও কর্ণফুলী টানেলের মতো লোকসানি ভাগ্য বরণ করতে পারে।"
পুনঃসমীক্ষা ছাড়া এভাবে র্যাম্প বাদ দেওয়া ঠিক হয়নি বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পটির সাম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষাও সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়নি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
চুয়েটের ব্যুরো অব রিসার্চ টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেশনের করা সমীক্ষায় নগরীর ওয়াসা, টাইগারপাস, বারিক বিল্ডিং, নিমতলী, কাস্টম হাউস, সিইপিজেড, সিমেন্ট ক্রসিং ও কাঠগড়ে দুটি করে মোট ১৬টি র্যাম্প রাখার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু এই সুপারিশ মানেনি সিডিএ।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০২৪ সালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রতিদিন ৭৭ হাজার ৪০১টি গাড়ি চলাচলের কথা ছিল। এটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হলে যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় যেমন কমবে, তেমনি মানুষের কর্মঘণ্টাও সাশ্রয় হবে। প্রকল্প ঘিরে চট্টগ্রামে আর্থসামাজিক উন্নয়ন হবে।
তবে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সাধারণ সম্পাদক, সিডিএর নতুন বোর্ড সদস্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি জেরিনা হোসেন টিবিএসকে বলেন, "প্রকল্পটির শুরু থেকেই অপরিকল্পিত। কৌশলগত ও প্রকৌশলগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। কত শতাংশ মানুষ র্যাম্প ব্যবহার করবেন, কারা কোথা থেকে উঠবেন, উপরে কারা চলাচল করবেন, নিচে কারা চলাচল করবেন, এর প্রভাব কেমন পড়বে— এসব বিষয়ে কোনো স্টাডি নেই।"
চুয়েটের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম বলেন, "আমাদের কাছ থেকে প্ল্যান নেওয়া হয়। কিন্তু কাজ করার সময় ঠিকভাবে করা হয় না। আবার জটিলতায় পড়লে প্ল্যান নেওয়া হয়।"
বিলম্ব ও বাজেট বৃদ্ধি
সিডিএর তথ্যমতে, ২০১৭ সালের অনুমোদিত প্রকল্পটির ব্যয় পাঁচ বছর পর ১ হাজার ৪৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা করা হয়।
তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালের জুনে শেষ করার কথা ছিল।
নকশা প্রণয়নের সময় অন্য কোনো সংস্থা ও বা অংশীজনদের মতামত না নেওয়ায় পদে পদে আপত্তি আসতে থাকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে। ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে আলাপ না করায় জটিলতা দেখা দেয়। নকশা পরিবর্তন, নতুন স্থাপনা যুক্ত, নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে।
২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর উদ্বোধর করা হলেও ২০২৪ সালের আগস্টে পরীক্ষামূলক যান চলাচল শুরু হয়। চলতি ২০২৫ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে টোল আদায় শুরু হয় উড়াল সড়কটিতে।