দেশের সবচেয়ে বড় জাহাজ রপ্তানি করলো আনন্দ শিপইয়ার্ড, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প
মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের এনজিয়ান শিপিং কোম্পানি লিমিটেডের কাছে ৬১০০ ডিডব্লিউটির একটি জাহাজ রপ্তানি করেছে আনন্দ শিপইয়ার্ড অ্যান্ড স্লিপওয়েজ লিমিটেড। বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিকৃত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জাহাজ এটিই।
২০১০ সাল থেকে টানা ১০ বছরের মন্দা কাটিয়ে এটি আনন্দ শিপইয়ার্ডের দ্বিতীয় জাহাজ রপ্তানি।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০১৮ সাল থেকেই বৈশ্বিক বাজারে আবারো অবস্থান ফেরাতে শুরু করেছে বাংলাদেশের জাহাজ শিল্প। দীর্ঘদিন পর ২০২০ সালে করোনার শুরুতে ৫৫০০ ডিডব্লিউটির আরেকটি জাহাজ রপ্তানি হয়। এখন রপ্তানির অপেক্ষায় আরো তিনটি জাহাজ।
তারা বলছেন, ইউরোপের বাজারে পরিবেশবান্ধব জাহাজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় জাহাজ রপ্তানিতে নতুন নতুন অর্ডার আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশও এখন পরিবেশবান্ধব জাহাজ নির্মাণ করছে।
শুধু আনন্দ শিপইয়ার্ড নয়, জাহাজ শিল্পে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন দেশের অন্য উদ্যোক্তারাও। জাহাজ নির্মাণে অনুকূল পরিবেশ থাকায় এ খাতে নতুন বিনিয়োগ বৃদ্ধিরও পরিকল্পনা রয়েছে উদ্যোক্তাদের।
চট্টগ্রাম-ভিত্তিক জাহাজ নির্মাণ কোম্পানি এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড সুদান সরকারের কাছ থেকে এএসডি টাগবোট নির্মাণের জন্য একটি নতুন কার্যাদেশ পেয়েছে, এই অত্যাধুনিক নৌযানের রপ্তানি মূল্য ১৩ মিলিয়ন ডলার।
যদিও সবার ভাগ্য এমন সুপ্রসন্ন নয়।
আনন্দ শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহহেল বারী বলেন, "২০০৮ সালে ডেনমার্কে অত্যাধুনিক কন্টেইনার জাহাজ 'স্টেলা মেরিস' রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি শুরু করি আমরা। এরপর মাত্র দুই বছরে বিভিন্ন দেশে ১১টি জাহাজ রপ্তানি হয়। এখন আবার রপ্তানি বাজার উন্মুক্ত হয়েছে।"
তিনি বলেন, "আনন্দ শিপইয়ার্ড ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে সোনারগাঁওয়ের মেঘনাঘাটে আন্তর্জাতিক মানের জাহাজ নির্মাণ করছে। ইয়ার্ডের বাৎসরিক উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩০ হাজার টন। দেশি-বিদেশি ক্রেতাদের কাছে ৩৫৬টি জলযান নির্মাণ করে সরবরাহ করেছি। রপ্তানি বাজারে আরো ভালো করার সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।"
বারী অ্যাসোসিয়েশন অব এক্সপোর্ট ওরিয়েন্টেড শিপবিল্ডিং ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশের সভাপতিও। তিনি বলেন, "জাহাজ নির্মাণ শিল্প দেশকে বছরে ১৫ হাজার কোটি টাকা যোগান দিয়ে থাকে। এই অংক ২০৪১ সালে ১০০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে।"
আনন্দ শিপইয়ার্ডের জাহাজ রপ্তানি উদ্বোধন করে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, "জাহাজ নির্মাণ শিল্প একটি সম্ভাবনাময় রপ্তানি খাত। অত্যাধুনিক জাহাজ নির্মাণে আমাদের দক্ষতা রয়েছে। আমারা প্রত্যাশা করছি ভবিষ্যতে এ শিল্পটি তৈরি পোশাক শিল্পের কাছাকাছি রপ্তানি আয় অর্জন করতে পারবে।"
তিনি বলেন, "সমুদ্রসীমা জয় করলেও আমরা সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে পারিনি। এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছি। সম্ভাবনাময় এ খাতকে এগিয়ে নেয়া জরুরি। সরকার এটিকে গুরুত্ব দিয়ে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম, মাতারবাড়ী, মোংলা, পায়রাসহ সব বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে।"
শিল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্ববাজারে ছোট ও মাঝারি নৌযানের জন্য বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। যদিও এ খাত প্রধানত অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা পূরণ করে, তবে গত এক দশকে রপ্তানি সন্তোষজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
দেশের প্রায় ৯০% জ্বালানী, ৭০% কার্গো এবং ৩৫% যাত্রী নৌপথে পরিবাহিত হয়, যা দেশের অভ্যন্তরে জাহাজের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি করেছে।
দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৩০০ শিপইয়ার্ড রয়েছে; যদিও এর মধ্যে মাত্র ১০টি প্রতিষ্ঠান রপ্তানিযোগ্য জলযান তৈরি করে। এ খাতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ জড়িত। অভ্যন্তরীণ বাজার ১০ থেকে ১৫% হারে বাড়লেও ৫ থেকে ৬% হারে বাড়ছে রপ্তানি বাজার।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) মতে, বর্তমানে ১০০টিরও বেশি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এবং নানা আকারের ১২০টিরও বেশি নিবন্ধিত শিপইয়ার্ড রয়েছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, দেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় তিন শতাধিক শিপইয়ার্ড রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি রপ্তানিযোগ্য জাহাজ তৈরি করে; এ খাতে প্রায় তিন লাখ মানুষ জড়িত।
রপ্তানি আদেশের জন্য বর্তমানে জাহাজের বার্ষিক নির্মাণ সক্ষমতা কমবেশি ২০ ধরা হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহারের জন্য স্থানীয়ভাবে নির্মিত নৌযানের মধ্যে রয়েছে এমপিভি, কন্টেইনার, বাল্কার, ট্যাঙ্কার, ড্রেজার, টাগ এবং যাত্রীবাহী ফেরি। আকারে এসব এক হাজার থেকে ২০ হাজার ডিডব্লিউটির মধ্যে।