রোগী কল্যাণ সমিতি: চিকিৎসা ব্যয়ে জর্জরিত রোগীদের জন্য এক টুকরো আশ্বাস
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গত একমাসের বেশি সময় চিকিৎসা নিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার সুইং অপারেটর মঞ্জুর আহমেদ। ৩০ বছর বয়সী মঞ্জুর পেটফোলা, বমিভাব, ও পেট ব্যথার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
তার স্ত্রী মরিয়ম জানান, মঞ্জুরের স্বাস্থ্যগত সমস্যা শুরু হয় চার মাস আগে। 'ও এখন আর কিছু খেতে পারে না বলে চিকিৎসকেরা ওকে প্রতিদিন কাবিভেন (শিরায় দেওয়ার স্যালাইন) দিতে বলেছেন,' হাসপাতালের বিছানায় স্বামীর পাশে বসা মরিয়ম বলেন।
কাবিভেনের একটি ব্যাগের দাম পড়ে ২,৩৩০ টাকা। প্রতিমাসে মঞ্জুরের ৬৯,৯০০ টাকার কাবিভেন দরকার হয়। তার পরিবারের পক্ষে এত টাকা খরচ করা অসম্ভব।
পারিবারিক আর্থিক অবস্থার কথা জেনে মঞ্জুরের চিকিৎসক প্রতি দুই দিন অন্তর অন্তর কাবিভেন গ্রহণের পরামর্শ দেন। কিন্তু মরিয়মের পক্ষে তাও সম্ভব হয়নি। গত মাসে কেবল চার ব্যাগ কাবিভেন কিনতে পেরেছিলেন তিনি।
শুরুতে গরু বিক্রি করে ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে মঞ্জুরের চিকিৎসা চালান মরিয়ম। এরপর নওগাঁয় নিজেদের পাঁচ শতক জমি এক লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেন তিনি।
মরিয়মের দুর্দশা দেখে একজন চিকিৎসক তাকে ঢামেকের হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। সারা দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে দুস্থ রোগীদের জন্য হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম বিনামূল্যে ঔষধ ও অন্যান্য চিকিৎসাসেবা সরবরাহ করে।
'ওখানে দেখা করার পর তারা আমাকে একটা ফর্ম পূরণ করতে দেয়। আমার স্বামীর চিকিৎসকের স্বাক্ষরেরও প্রয়োজন হয় সেখানে। কার্যালয়ে ওই ফর্মটা দাখিল করার পরদিন আমি একটি কাবিভেন বিনামূল্যে পাই,' বলেন মরিয়ম।
২০২১ অর্থবছরের সারা দেশের ৫২৮টি হাসপাতালে মরিয়মের মতো প্রায় সাত লাখ ৩৩,৬৭৭ জন দুস্থ রোগী হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যক্রম থেকে সহায়তা পেয়েছেন। এ হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয়ের জনবল ও তহবিলের যোগান দেয় রোগী কল্যাণ সমিতি। এটি বাংলাদেশে সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালিত একটি জনকল্যাণমূলক প্রকল্প।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রোগী কল্যাণ সমিতি ২০২১ সালে রোগীদেরকে ২০ কোটি ৭৩ লাখ টাকা সহায়তা দিয়েছে। ওই বছর সমিতি পেয়েছিল ২০ কোটি ২০ লাখ টাকা। অন্যদিকে সরকার থেকে দেওয়া হয় ১৫ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ কোটি টাকার উৎস ছিল জাকাত, অনুদান, ও সমিতির বিভিন্ন বিনিয়োগের লভ্যাংশ।
তবে এ আর্থিক সাহায্য অবশ্য প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল। তহবিলের অভাবে প্রায়ই অনেক রোগীকে খালি হাতে ফিরতে হয় এ সমিতি থেকে।
যেভাবে শুরু
১৯৫৮ সালে সমাজকল্যাণের দুজন কর্মকর্তা ঢামেকে প্রথমবারের মতো এ প্রকল্পটি চালু করেছিলেন। এরপর থেকে এটির কলেবর বড় হয়েছে। বর্তমানে দেশের ৫২৮টি হাসপাতালে এটি চালু আছে। এসবের মধ্যে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতাল, এবং ঢাকা শহরের ভেতরে অবস্থিত বিশেষায়িত হাসপাতাল।
পথ্য ও অস্ত্রোপচারসংক্রান্ত ঔষধের পাশাপাশি যেসব রোগী সুস্থ হওয়ার পর টাকার অভাবে বাড়ি ফিরতে পারেন না, তাদেরকে গাড়িভাড়া দেয় সমিতি। এছাড়া বাড়িতে লাশ নিয়ে যাওয়ার খরচও পাওয়া যায় সমিতি থেকে।
কোনো রোগী স্বজন ছাড়া একা হাসপাতালে এলে তাদের চিকিৎসার ভারও গ্রহণ করে রোগী কল্যাণ সমিতি। দরিদ্র রোগীদের হুইলচেয়ার, ক্রাচ, ওয়াকার, ও শীতে কম্বল কিনতেও সহায়তা করে এ সমিতি।
ঢামেকের হাসপাতাল সমাজসেবা কর্মকর্তা দীপিকা রানি সাহা জানান, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিসি সেন্টারের (ওসিসি) মাধ্যমে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিদের প্রয়োজনে সব খরচ বহন করে এ সমিতি। এছাড়া রোগীদের কেমোথেরাপি ও ডায়ালেসিসের জন্যও অর্থ প্রদান করা হয়। কিন্তু এ সমিতি রোগীদের কত টাকা করে দেয়?
'সম্প্রতি একজন রোগীর দুটি স্টেন্টের (হৃৎরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ছোট টিউব) প্রয়োজন হয়েছিল। ওই অপারেশনের জন্য রোগীর পরিবারের দুই লাখ টাকা লাগত। ওই পরিবারটি আমাদের কার্যালয়ে আসার পর আমি কেবল ৫,০০০ টাকা দিতে পেরেছিলাম। এটাই আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিমাণ। (ঢামেকের) নিয়ম অনুযায়ী কোনো একজন রোগীকে এর বেশি টাকা দেওয়া যায় না,' জানান দীপিকা।
যেভাবে কাজ করে ব্যবস্থাটি
সমাজসেবা কার্যালয় রোগীদের একটি ফর্ম পূরণ করতে দেয়। ফর্মে রোগীর জন্য নিযুক্ত চিকিৎসকের স্বাক্ষর ও সঙ্গে ব্যবস্থাপত্রের ফটোকপি দরকার হয়। এরপর এ ফর্মটি হাসপাতালের ঔষধের দোকানে পাঠায় কার্যালয়। উদ্দেশ্য- ঔষধগুলো সেখানে আছে কিনা তা জানা। হাসপাতালের দোকানে কোনো ঔষধ থাকলে সেটা আর এ কার্যালয় থেকে রোগীদের দেওয়া হয় না।
'ডাক্তার ও রোগীর স্বাক্ষর ছাড়া আমরা কোনো ঔষধ দিই না,' দীপিকা উল্লেখ করেন।
তহবিলের উৎস
রোগী কল্যাণ সমিতির তহবিলের উৎস তিনটি। বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ তহবিলের একটি অংশ প্রদান করে। আরেকটি অংশ আসে জাকাত ও ফিতরা থেকে। বাকি অর্থ পাওয়া যায় ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক অনুদানের মাধ্যমে।
২০২১ অর্থবছরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর হাসপাতাল সমাজসেবা কার্যালয় সর্বোচ্চ ২৪ লাখ টাকা সরকারি অনুদান লাভ করে। ওই বছর এ হাসপাতালের সমিতির মোট তহবিল ছিল এক কোটি ১৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা। এর মধ্যে একটি এফডিআর'র ৩৫ লাখ টাকাও ছিল। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে এসব তথ্য জানিয়েছেন হাসপাতালটির সমাজসেবা কর্মকর্তা বেগম সিতারা ইয়াসমিন।
'জাকাত ও ফিতরা থেকে আমাদের তহবিলের প্রায় ৫০ শতাংশ আসে। রমজান মাসে মানুষের বাসায় গিয়ে আমরা এটা সংগ্রহ করি', বলেন দীপিকা রানি সাহা।
জরুরি পরিস্থিতির জন্য এ তহবিলের কিছু অংশ সঞ্চয় করে রাখতে হয়। তবে জাকাতের টাকা এক বছরের মধ্যেই কাজে লাগাতে হয় বলে জানান দীপিকা।
কোনো বছর মোট কত টাকার তহবিলের জন্য পাওয়া যাবে তার কোনো নিশ্চিয়তা থাকে না। সিতারা ইয়াসমিন জানান, এ জন্য তাদেরকে একটি বার্ষিক বাজেট নির্ধারণ করে কাজ করতে হয় যাতে বছর শেষের আগে তহবিল খালি হয়ে না যায়।
ঢামেকের মতো বিএসএমএমইউ'র সমাজসেবা কার্যালয়ও রোগীদের হুইলচেয়ার, ক্রাচ, ওয়াকার, শীতের কম্বল, এবং শাড়ি-লুঙ্গি ইত্যাদি প্রদান করে। অনেক সমিতি থেকে খাবারও দেওয়া হয়।
এ যেন বিশাল সমুদ্রের এক বিন্দু পানির মতো
রাজধানী ঢাকার আগারগাঁওয়ে অবস্থিত জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এর সমাজসেবা কর্মকর্তা রৌশনারা খাতুন বলেন, ২০২১ অর্থবছরে তারা সরকারের কাছ থেকে ১৪ লাখ টাকা পেয়েছেন। এ প্রতিষ্ঠানের সমাজসেবা কার্যালয়ের মোট তহবিল এক কোটি টাকার।
এর মধ্যে ৬০ শতাংশই এসেছে অনুদান ও জাকাত থেকে। 'প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন মানুষ এখানে সহায়তার জন্য আসেন, কিন্তু তাদের তিন ভাগের এক ভাগকে আমাদের শূন্য হাতে ফেরত পাঠাতে হয়,' বলেন রৌশনারা।
তিনি আরও জানান, 'নিটোরে ৫০০টি বিনামূল্যের বিছানা আছে। আমরা মোটামুটি ১৫০ জনকে সহায়তা করতে পারি।'
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল-এর সমাজসেবা কর্মকর্তা কামরুন নাহার বেগম বলেন, তারা বছরে ৭-৮ লাখ টাকা পান। গত অর্থবছর তারা নয় লাখ টাকা খরচ করেছেন, যার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ।
'মানসিক হাসপাতালগুলোর জন্য বড় দাতা মেলে না,' কামরুন নাহার বেগম বলেন।
জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোও তহবিল সংকটে ভোগে। 'হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস)-২০১৬-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের দরিদ্রতম জেলা হলো কুড়িগ্রাম।
কুড়িগ্রাম সদর হাসপাতালের সমাজসেবা কর্মকর্তা সুকান্ত সরকার বলেন, গত অর্থবছরে তারা সরকারের কাছ থেকে আট লাখ টাকা পেয়েছেন। সবমিলিয়ে তহবিলে জমা পড়েছিল নয় লাখ ৫১ হাজার টাকা।
'একজন রোগীকে সর্বোচ্চ ২০০০ টাকা দিতে পারি আমরা,' বলেন সুকান্ত। তিনি জানান, গত বছর দুস্থ রোগীদেরকে এই হাসপাতালের সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ১১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশি নাগরিকদের চিকিৎসা খরচের ৬৮.৫০ শতাংশ তাদের পকেট থেকে দিতে হয়।
ঢামেক পরিচালক ও ঢামেক রোগী কল্যাণ সমিতি'র চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, হাসপাতালটিতে যারা চিকিৎসার জন্য আসেন, তাদের পক্ষে হাসপাতালে দীর্ঘদিন অবস্থান করে চিকিৎসা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। অনেক রোগীকে গবাদিপশু, জমি ইত্যাদি বিক্রি করে দিতে হয় চিকিৎসার খরচ চালানোর জন্য।
'হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেবল রোগীদেরকে খাবার সরবরাহ করে, তাদের সঙ্গে থাকা আত্মীয়স্বজনদেরকে নিজের টাকায় খাবার খেতে হয়,' নাজমুল হক বলেন।
এক কোটি টাকা অপর্যাপ্ত উল্লেখ করে হক জানান, তারা যেটুকু পান তা দিয়ে সেবা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। রোগী কল্যাণ সমিতিতে অবদান রাখার জন্য আমরা বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করছি। তিনি বিশ্বাস করেন, তারা তাদের সিএসআর তহবিল থেকে অনুদান দিতে পারে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রোগ্রাম) সাব্বির ইমাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ রোগী কল্যাণ সমিতি'র জন্য অর্থ বরাদ্দ করে।
'আমি তাদেরকে অনেকবার বরাদ্দ বাড়ানোর অনুরোধ করেছি,' সাব্বির ইমাম বলেন।
বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নির্বাহী সচিব মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন বলেন, রোগী কল্যাণ সমিতি'র আওতাধীন ৫২৮টি হাসপাতালে তাদেরকে ২০২১-২২ আর্থিক বছরে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দিতে হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পরিষদ ১৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছিল।
তিনি জানান, সরকারের বাজেটের পরিমাণ বাড়ায় তারাও প্রতিবছর বরাদ্দ বাড়ান।
'চাহিদা অনেক বেশি। যদি বেশি বরাদ্দ পাওয়া যেত, তাহলে আরও বেশি রোগীকে সেবা দেওয়া যেত।'
ঢামেকে মঞ্জুরের স্ত্রী মরিয়ম জানেন না তাকে আরও কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে।
'নিদেনপক্ষে আমি কাবিভেনের একটা ব্যাগ পাচ্ছি এখন। আমাদের মতো গরীবদের জন্য এটা বিশাল উপকার। তারা যদি আরও বেশি সহায়তা করতে পারত, তাহলে আরও ভালো হতো,' হাসপাতালে স্বামীর বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলেন মরিয়ম।