মরিয়ম কি ফেঁসে যাচ্ছেন!
নিখোঁজ থেকে উদ্ধার হওয়ার পর মরিয়ম আক্তার ওরফে মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগম আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তার সত্যতা পায়নি পুলিশ ব্যুরো অভ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। শীঘ্রই তাদের সাজানো নাটকের রহস্য প্রকাশ্যে আনার চেষ্টা করছে সংস্থাটি। পূর্ণাঙ্গ তদন্তে মরিয়মরা দোষী হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পিবিআই খুলনার পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান।
তিনি বলেন, 'রহিমা বেগম আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেই তথ্য আমরা ক্রস-ম্যাচিং করে দেখেছি। ইতিমধ্যে তাকে অপহরণের বিষয়টি আমাদের কাছে ভুয়া প্রমাণ হয়েছে। তদন্তের অগ্রগতিতে মনে হচ্ছে প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমিজমা-সংক্রান্ত তাদের যে বিরোধ আছে, তাতে প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর জন্য তারা এই নাটক করে থাকতে পারেন।'
পিবিআই পুলিশ সুপার আরও বলেন, 'রহিমা পুলিশকে বলেছেন, হুঁশ ফিরে সাইনবোর্ড পড়ে দেখেন তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম লেখা। ওই স্থানটি হলো বান্দরবান সদরের ইসলামপুর। সেখানে তিনি মণি বেগমের ভাতের হোটেলে কাজ করেছেন। মনি বেগম তাকে স্থানীয় একটি ক্যাম্পে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। সেজন্য তার কাছে জন্মনিবন্ধন ও এনআইডি কার্ড চাওয়া হয়েছিল। এগুলোর জন্য তিনি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে তার পূর্বপরিচিত কুদ্দুস মোল্লার বাড়িতে যান। সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হকের কাছে গিয়ে জন্ম নিবন্ধন ও এনআইডি দাবি করেন। তবে সেখান থেকে তাকে তাকে জন্ম নিবন্ধন ও এনআইডি দেওয়া হয়নি।'
তিনি বলেন, 'তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। পূর্ণাঙ্গ তদন্তে যদি মরিয়ম ও তার পরিবার দোষী হয়, তবে আইন মোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া মরিয়মদের মামলায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তদন্তে যদি তারা নির্দোষ হন, তবে তারাও আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারবেন।'
গত ২৭ আগস্ট রাতে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়ার বাড়ি থেকে রহিমা বেগম নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ করেন মরিয়ম ও তার ভাইবোনেরা। পরেরদিন ২৮ আগস্টে দৌলতপুর থানায় মামলা করেন রহিমার মেয়ে আদুরী আক্তার। আসামি করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় কয়েকজনকে। মামলায় জড়ানো হয় জমি-সংক্রান্ত বিরোধীদের নাম। সেই মামলায় প্রতিবেশী মঈন উদ্দিন, গোলাম কিবরিয়া, রফিকুল ইসলাম পলাশ, মোহাম্মাদ জুয়েল, হেলাল শরীফসহ রহিমা বেগমের দ্বিতীয় স্বামী বেল্লাল হাওলাদার কারাগারে রয়েছেন।
পরে ২৪ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফরিদপুরে বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে রহিমা বেগমকে জীবিত উদ্ধার করে পুলিশ। পরেরদিন তাকে আদালতে হাজির করা হলে নিজেকে অপহরণের দাবি করে জবানবন্দি দেন। সেই সময়ে মেয়ে আদুরী আক্তারের জিম্মায় তাকে মুক্তি দেয় আদালত।
মরিয়মের মায়ের জবানবন্দিতে যত গরমিল
আদালতের নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রহিমা বেগম তার জবানবন্দিতে বলেছেন, 'গত ২৭ আগষ্ট পানি নেওয়ার জন্য আমি বাসার নিচে আসি। এক বালতি নেয়ার পরে অন্য বালতি নিতে আসলে আসামিদের সাথে আরও অনেক লোক আমার বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। তখন রাত ১০টা বাজে। আসামি পলাশ ও মহিউদ্দিন কাপড় দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরে। তখন আমার সাথে থাকা মোবাইলও আসামিরা নিয়ে যায়। আসামীরা আমাকে কোলে তুলে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার হুঁশ ফিরে আসলে তাকিয়ে দেখি সাইনবোর্ডে পার্বত্য চট্টগ্রাম লেখা। তারপর আমি রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে ঢাকা আসি। ঢাকা থেকে মুকসেদপুর আসি। সেখান থেকে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামে আমার ভাড়াটিয়ার বাড়ি তথা কুদ্দুসদের বাড়ি যাই। তাদেরকে ঘটনা খুলে বলি। তাদের বাড়ি আমি ৮-৯ দিন ছিলাম। সেখান থেকে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে আসে। এই আমার জবানবন্দি।'
আদালতের এই জবানবন্দির সত্যতা যাচাই করতে গত মঙ্গলবার দিনব্যাপী ফরিদপুরে বোয়ালমারীতে ছিলেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পরিদর্শক আবদুল মান্নান। তিনি বলেন, 'আমি জবানবন্দির সত্যতা যাচাই করতে বোয়ালমারী গিয়েছিলাম। বোয়ালমারীতে রহিমা যে কথা বলেছেন, আদালতে সেইভাবে জবানবন্দি দেননি। সেখানে স্বামী ও মেয়েদের সাথে ঝগড়া করে এসেছেন বলে জানিয়েছেন। যার সাথে জবানবন্দির মিল নেই।
'এছাড়া জবানবন্দিতে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম বলতে বান্দরবানকে বুঝিয়েছেন। আমরা জানি বান্দরবানে কোনো ট্রেন লাইন নেই।'
তিনি বলেন, 'রহিমাদের সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। বিষয়টি তার স্বামী ও সন্তানরাও জানতেন। তদন্ত শেষে মামলাটি ভুয়া প্রমাণ হলে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা মুক্তি পাবেন। তখন তারা চাইলে রহিমা ও তার সন্তানদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন।'
রহিমা বেগম যে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন, ওই বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রধান পথ মাত্র একটি। সেখান দিয়ে একসঙ্গে দুই বা ততোথিক মানুষ একত্রে বের হতে পারেন। অন্য দুটি পথ দিয়েও বের হওয়া যায়। যার মধ্যে একটি বাথরুমে যাওয়ার পথ, অন্যটি ময়লা ফেলার পথ। সেখান থেকে একত্রে দুজন বা তার বেশি বের হওয়া যায় না।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্রধান পথের দিকে তাক করা দুটি বাড়িতে তিনটি সিসি ক্যামেরা লাগানো রয়েছে। ওই ক্যামেরা দুটি থেকে পাওয়া ফুটেজ দেখে পুলিশ জানাচ্ছে, রাত ৯টা ২৮ মিনিটে রহিমা বেগম প্রধান পথ দিয়ে রাস্তার কাছে একবার এসেছিলেন। তখন তিনি আকাশি রঙের কামিজ ও লাল পাজামা পরা ছিলেন। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে তিনি আবারও বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন।
ওই বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়া আকলিমা বেগম বলেন, 'রাত ১১টার দিকে রহিমার স্বামী বেল্লাল হাওলাদার আমাদের জানায়, রহিমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। পরে তিনি নিচে নামেন এবং সোজা ঝোপের দিকে গিয়ে বলেন, এই তো রহিমার জুতা পড়ে আছে। পরে একটি ওড়নাও তিনি ঝোপ থেকে বের করেন।'
তিনি বলেন, 'সেই ঝোপ ও আমাদের ঘরের দরজার দূরত্ব মাত্র ১০ হাত। একজন মানুষকে এখান থেকে অপহরণ করে কেউ নিয়ে যাবে, অথচ আমরা একটুও শব্দ পাব না, তা কী করে হয়। আসলে কী ঘটেছে আমরা জানি না।'
রহিমা বেগমের জবানবন্দির তথ্য শুনে বিস্মিত হয়েছে বোয়ালমারীর আশ্রয়দাতারাও। বোয়ালমারীর সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার ভাগনে জয়নাল বলেন, 'আমি ফেসবুক ও ইউটিউবে দেখতে পাই মরিয়ম মান্নান মায়ের খোঁজে কান্নাকাটি করছেন। তখন মেয়ের ছবি দেখিয়ে তাকে বলি, এরা আপনাকে খুঁজছে কি না। তখন তিনি হতভম্ব হয়ে যান। বলেন, আমার মতোই লাগছে।
'রহিমা বেগম তখন বলেছিলেন, আমি মেয়েদের কাছে যেতে চাই না। মেয়েরা ভালো না। জায়গা-জমি বিক্রি করে টাকাপয়সার ভাগ চায় তারা। মেয়েদের সাথে যোগাযোগ করার দরকার নেই।'
জয়নাল বলেন, 'বিষয়টি জানাতে তার ছেলে মিরাজকে ফোন করলে তার স্ত্রী বিরক্ত প্রকাশ করেন। তাছাড়া রহিমাকে ফেসবুকে জানানো হলেও তিনিও কোন সাড়া দেননি।'
তিনি আরও বলেন, 'পরে বিষয়টি আমি স্থানীয় ইউপি সদস্য মোশারফ হোসেনকে জানাই। তিনি খুলনার ২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হন নিখোঁজ হওয়া রহিমা বেগমই ওই নারী। তখন তিনি কাউন্সিলরের মাধ্যমে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করে তাকে উদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেন।'