বিজয়নগর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া যোগাযোগে স্বস্তি আনতে ‘শেখ হাসিনা সড়ক’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের লক্ষ্মীমোড়া গ্রামের কৃষক মো. শাহজাহান শাকসবজি বিক্রি করে তার পরিবার চালান। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় উৎপাদিত শাকসবজি শহরের হাটে তুলতে সমস্যা হতো তার। হাওর এলাকা হওয়ায় নৌকায় করে শহরে আসতে আসতে বেলা হয়ে যেতো। এর ফলে বাজারে এসে সবজির ভালো দাম পেতেন না।
তবে এবার শাহজাহান বাড়ি থেকে 'শেখ হাসিনা সড়ক' দিয়ে মাত্র আধা ঘণ্টায়ই পৌঁছাতে পারবেন শহরের হাটে। এতে করে পণ্যের ন্যায্য দাম যেমন পাবেন, তেমনি ঘুচবে দীর্ঘদিনের আক্ষেপও।
কৃষক শাহজাহানের মতো পুরো বিজয়নগর উপজেলাবাসীর ভাগ্য বদলে দেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিরাইলকান্দি থেকে বিজয়নগর উপজেলার পত্তন ইউনিয়নের সিমনা পর্যন্ত নির্মাণাধীন 'শেখ হাসিনা সড়ক'। হাওরের বুকে এই সড়কটি বিজয়নগরবাসীর বহু বছরের লালিত স্বপ্ন।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সাথে বিজয়নগর উপজেলার সরাসারি কোনো সংযোগ সড়ক নেই। প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে জেলার আখাউড়া অথবা সরাইল হয়ে জেলা সদরে আসতে হয়। এতে সময় লাগে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় পত্তন, সিঙ্গারবিল, চম্পকনগর, বিষ্ণুপুর ও পাহাড়পুর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের।
বর্ষাকালে হাওড় পাড়ি দিয়ে জেলা শহরে আসতে তাদের একমাত্র ভরসা নৌকা, আর শুষ্ক মৌসুমে পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প নেই। তাই কয়েক দশক ধরেই বিজয়নগরবাসী দাবি জানিয়ে আসছিলো হাওরের বুকে সড়ক নির্মাণের। কিন্তু হাওরে সড়ক নির্মাণ অনেকটা চ্যালেঞ্জিং ছিল সংশ্লিষ্টদের জন্য। বছরের অর্ধেক সময় পানিতে টইটম্বুর থাকে বিস্তীর্ণ হাওর এলাকা।
অবশেষে সকল বাধা ডিঙিয়ে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের শিরাইলকান্দি থেকে বিজয়নগরের পত্তন ইউনিয়নের সিমনা পর্যন্ত সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হয়। ভূমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতার কারণে নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হলেও এখন কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সড়কটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৩৫ কোটি টাকা। ইতোমধ্যে সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শেখ হাসিনা সড়ক।
বর্ষাকালে ভাঙন রোধে সড়কের পাশে বসানো হয়েছে সিসি ব্লক। সড়কের তিনটি সেতুর সবকটিরই নির্মাণ কাজ শেষ। সেতুর এপ্রোচ সড়কের কাজ শেষ করে শুরু হবে কার্পেটিং কাজ। এরপরই খুলে দেওয়া হবে স্বপ্নের শেখ হাসিনা সড়ক। সাড়ে ৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সড়ক শুধু যে শহরের সাথে দূরত্বই কমাবে তা নয়; ভূমিকা রাখবে স্থানীয় কৃষি, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে।
কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি বছর বিজয়নগর উপজেলায় প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের আম, লিচু, মাল্টা ও কাঁঠালসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল উৎপাদিত হয়। কিন্তু যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় কৃষকরা যথাসময়ে এসব ফল জেলা শহরে নিয়ে যেতে পারতেন না। এতে করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতেন তারা। এখন শেখ হাসিনা সড়ক ব্যবহার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে উৎপাদিত ফল শহরে নিয়ে যেতে পারবেন কৃষকরা।
পত্তন ইউনিয়নের মনিপুর গ্রামের বাসিন্দা বিলকিস বেগম জানান, 'আগে গ্রামের আশেপাশে কলেজ না থাকায় মেয়েদের শিক্ষা স্কুল পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। কারণ ছেলেরা শহরে গিয়ে পড়তে পারলেও দূরের পথ হওয়ায় নিরাপত্তার কারণে শহরে পড়তে দেওয়া হতো না মেয়েদের। এখন সড়ক চালু হলে মেয়েরাও শহরে গিয়ে ভালো কলেজে পড়তে পারবে।'
চম্পকনগর ইউনিয়নের চম্পকনগর গ্রামের কৃষক হাবিব মিয়া জানান, প্রতি বছর তার লিচু বাগান থেকে লক্ষাধিক টাকার লিচু বিক্রি হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় লিচুগুলো শহরে নিয়ে যেতে না পারায় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে হয়। শেখ হাসিনা সড়কটি চালু হলে শহরে নিয়ে লিচুগুলো আরও বেশি দামে বিক্রি করতে পারবেন বলে জানান তিনি।
চম্পকনগর বাজারের ব্যবসায়ী মো. রাসেল জানান, 'জেলা শহর থেকে মালামাল আনার জন্য আখাউড়া অথবা সরাইল উপজেলা ঘুরে যেতে হয়। এতে করে পরিবহন খরচ বেড়ে যায়। আর এর প্রভাব পড়ে পণ্যের মূল্যে। এছাড়া নৌপথে মালামাল আনাটা ঝুঁকিপূর্ণ। শেখ হাসিনা সড়কটি চালু হলে সহজে এবং কম খরচে পণ্য আনা যাবে জেলা শহর থেকে। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এর সুফল পাবেন সাধারণ ক্রেতারাও।'
অন্যদিকে, সড়ক চালু না হলেও হাওরের স্বচ্ছ জলরাশির সঙ্গে নীল আকাশের মিতালি দেখতে এখন থেকেই শেখ হাসিনা সড়কে ভিড় জমাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। বর্ষাকালে এটিই হয়ে উঠবে অন্যতম পর্যটন স্পট। সব মিলিয়ে শেখ হাসিনা সড়কটিকে কেন্দ্র করে প্রসার ঘটবে ব্যবসা-বাণিজ্যের।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সিরাজুল ইসলাম বলেন, 'হাওরের বুকে শেখ হাসিনা সড়ক সকল ক্ষেত্রেই বিপ্লব ঘটাবে। মূলত সড়কের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল। এজন্য নির্মাণ কাজ কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে। তবে নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। কার্পেটিংও দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু হবে। এরপরই জনসাধারণের চলাচলের জন্য সড়কটি খুলে দেওয়া হবে।'