ডব্লিউটিওর নেট খাদ্য আমদানিকারকের স্বীকৃতি চাইবে ঢাকা
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কাছে নেট খাদ্য আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশের (এনএফআইডিসি) স্বীকৃতির জন্য আবেদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, এ স্বীকৃতি পাওয়া গেলে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পরও কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি বা নগদ সহায়তা দিতে পারবে বাংলাদেশ।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর শুল্ক সুবিধা প্রত্যাহারের কারণে এমনিতেই বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ পরিস্থিতিতে কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে সরকার বাংলাদেশকে এনএফআইসিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে টিবিএসকে জানিয়েছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
এজন্য চলতি বছর থেকে সরকার দেশের খাদ্যপণ্য আমদানি ও রপ্তানির তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ডব্লিউটিওকে জানাবে বলেও জানান তারা।
ডব্লিউটিওর নিয়মানুযায়ী, একটি দেশ পরপর পাঁচ বছরের মধ্যে তিন বছর কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানির চেয়ে অধিক পরিমাণ আমদানি করলে ওই দেশ এনএফআইসি হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
যেকোনো ধরনের ভোজ্য আইটেমকে খাদ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনা করে ডাব্লিউটিও।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান টিবিএসকে বলেন, 'এনএফআইসি তালিকাভুক্ত হতে আগামী ডিসেম্বরে প্রথমবারের মতো ডাব্লিউটিওতে তথ্য পাঠাব। আশা করছি, ২০২৫ সালে বাংলাদেশ এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবে এবং এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পরও ২০৩০ সাল পর্যন্ত কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়া যাবে।'
বাংলাদেশ প্রতিবছরই রপ্তানির তুলনায় কয়েকগুণ বেশি খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানি করলেও স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়ার সুবিধা থাকায় এতদিন এ ধরনের উদ্যোগ নেয়নি সরকার।
এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর রপ্তানি সক্ষমতা ধরে রাখতে সরকারের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে ভর্তুকি দিয়ে অনন্তকাল রপ্তানি করা যাবে না। বরং সরকার ও রপ্তানিকারকদের উচিত কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাড়াতে উৎপাদন হতে শিপমেন্ট পর্যন্ত উত্তম কৃষি চর্চা (গ্যাপ), গুড হাইজিন প্র্যাকটিসেস (জিএইপপি), গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিসেস (জিএমপি) অনুসরণ করাসহ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন অ্যাক্রিডিটেড ল্যাব স্থাপন করে দেশি পণ্যের মান নিশ্চিত করা।
বিভিন্ন ধরনের কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে, যা মূলত রপ্তানি ভর্তুকি।
কৃষি ও খাদ্যপণ্যের মধ্যে বাংলাদেশ মূলত সবজি, ফলমূল, হিমায়িত মাছ, কাঁকড়া, কুঁচে, সুগন্ধি চাল, সয়াবিন ও রাইস ব্র্যান তেল রপ্তানি করে। বাংলাদেশ থেকে চাল, গম, মসুর ডালসহ প্রধান প্রধান খাদ্যপণ্যগুলো রপ্তানিতে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের কৃষিজাত পণ্য এবং ৫৩৩ মিলিয়ন ডলারের হিমায়িত ও জীবন্ত মাছ রপ্তানি করেছে। এ সময় বাংলাদেশ ৮.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের খাদ্যপণ্য আমদানি করেছে। এর মধ্যে চাল ও গম আমদানি হয়েছে ২.৫৬ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া অন্যান্য খাদ্যপণ্য আমদানিতে ৫.৭৮ বিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান এনএফআইডিভুক্ত হওয়ার উদ্যোগকে সমর্থন দিয়ে বলেন, 'এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশ সার, সেচসহ কৃষি খাতে ভর্তুকি দিতে পারবে। তবে রপ্তানির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ভর্তুকি দিতে পারবে না। তাই কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার মাধ্যমে রপ্তানি প্রতিযোগিতা ধরে রাখার অংশ হিসেবেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ডাব্লিউটিওর এনএফআইডিসিভুক্ত হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, যা খুবই যৌক্তিক।'
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও এ উদ্যোগকে সমর্থন দিয়ে বলেন, ডাব্লিউটিওর এনএফআইসিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অর্থ হলো, কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা অর্জন করতে ভর্তুকি অব্যাহত রেখে বাড়তি কয়েক বছর সময় নেওয়া।
'সে হিসেবে উদ্যোগটি ঠিক আছে,' বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, 'আমাদের দেশের কৃষকরা ভর্তুকি ছাড়া চলতে পারবে না। ইউরোপও তাদের কৃষকদের বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দেয়। তবে রপ্তানিতে ভর্তুকি দেওয়ার সুবিধা চিরকাল থাকবে না। তাই কৃষিতে কম্পিটিটিভনেস দরকার। ফুড প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো দরকার। একইসঙ্গে রপ্তানি সক্ষমতা বাড়াতে গুড এগ্রিকালচার প্র্যাকটিস, সার্টিফিকেশন, অত্যাধুনিক ল্যাব স্থাপন জরুরি।'
'রপ্তানিতে ভর্তুকি হলো প্যারাসিটামল দিয়ে পরিস্থিতি ধরে রাখার চেষ্টা, যা টেকসই নয়। তাই ভর্তুকি প্রত্যাহার করার সময়ের আগেই, অর্থাৎ ২০৩০ সালের আগেই কৃষি ও খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাড়াতে সাপ্লাই সাইড কনটস্ট্রেইন্টস কাটিয়ে ওঠার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে হবে,' জানান তিনি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক এমএ রাজ্জাকও বাংলাদেশকে এনএফআইডিসি দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার সরকারের সিদ্ধান্তকে 'অত্যন্ত সময়োপযোগী' বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এই স্বীকৃতি পেলে খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী চলমান খাদ্য সংকটের সময় দেশের জন্য বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্য সহায়তা ও খাদ্য সহায়তা পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
এমএ রাজ্জাক বলেন, ভর্তুকি-সংক্রান্ত ডব্লিউটিও চুক্তি অনুসারে, এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়ার পরও একটি দেশ রপ্তানি ভর্তুকি দিতে পারে, যদি ১৯৯০ সালকে ভিত্তি বছর ধরে তার মাথাপিছু আয় ১ হাজার ডলারের কম হয়। এই হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখনও ১ হাজার ডলারের নিচে।
ডব্লিউটিওর তথ্যানুসারে, সংস্থাটির কৃষিবিষয়ক কমিটি দ্বারা প্রস্তুতকৃত তালিকার ভিত্তিতে বর্তমানে ৬৪টি উন্নয়নশীল দেশ এনএফআইডিসির সুবিধা পাওয়ার যোগ্য।
এ তালিকায় জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের স্বীকৃতি পাওয়া ৪৮টি স্বল্পোন্নত উন্নয়নশীল দেশ রয়েছে।
তালিকায় থাকা বাকি ১৬টি দেশ হলো ডব্লিউটিওর উন্নয়নশীল সদস্য দেশ। এই দেশগুলো তাদের এনএফআইডিসির তালিকাভুক্ত করার অনুরোধ করেছে এবং প্রতিনিধিত্বকালীন সময়ে মৌলিক খাদ্য সামগ্রীর নেট-আমদানিকারক হিসেবে তাদের অবস্থান সম্পর্কিত প্রাসঙ্গিক পরিসংখ্যানগত তথ্য জমা দিয়েছে। এই দেশগুলো হল—বার্বাডোস, কট ডি'আইভরি, ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র, মিশর, হন্ডুরাস, জ্যামাইকা, কেনিয়া, মরিশাস, মরক্কো, পেরু, সেন্ট লুসিয়া, সেনেগাল, শ্রীলঙ্কা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, তিউনিসিয়া ও ভেনেজুয়েলা।
১৯৮৬ সালে কৃষিবিষয়ক শুল্ক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত সাধারণ চুক্তির (গ্যাট) উরুগুয়ে রাউন্ডের আলোচনার সময় নেট খাদ্য আমদানিকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি গ্রুপ উদ্বেগ প্রকাশ করে যে, কৃষি বাণিজ্য উদারীকরণ ও সংস্কারের সুবিধাগুলো স্বল্প থেকে মধ্য মেয়াদে কমে যেতে পারে বা একেবারেই নেই হয়ে যেতে পারে।
এই উদ্বেগের প্রতিক্রিয়ায় ১৯৯৪ সালে মারাকেশে বিভিন্ন দেশের মন্ত্রীরা স্বল্পোন্নত ও নেট খাদ্য আমদানিকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এনএফআইডিসি সুবিধা চালু করেন।