ডেঙ্গুর প্রকোপ: চিকিৎসা খরচে নাজেহাল রোগীরা
সপ্তাহখানেক আগে ডেঙ্গু জ্বর ধরা পড়ে মাহমুদা আক্তার বৃষ্টির ছয় বছরের ছেলে জুনায়েদের। ডেঙ্গু আক্রান্ত ছেলেকে প্রথমে তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা দিতে থাকেন। এতে তার খরচ হয় প্রায় ১২ হাজার টাকা।
কিন্তু জুনায়েদের শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইন্সটিটিউটে (বিএসএইচআই) ভর্তি করা হয়। সেখানে মাত্র দুদিনেই তার চিকিৎসায় খরচ হয়েছে ৭ হাজার টাকা।
মাহমুদা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করেন। তার স্বামী শফিকুল পেশায় দারোয়ান। দুজনের মিলিত মাসিক আয় ২০ হাজার টাকা। এমনিতেই বাসা ভাড়া দেওয়ার পর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়, এর মধ্যে ছেলের চিকিৎসা ও যাতায়াতে প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এভাবে আরও কতদিন জুনায়েদের চিকিৎসা চালাতে হবে, তারা জানেন না।
চিকিৎসকেরা বলেন, ডেঙ্গু প্যারাসিটামল ছাড়া তেমন কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। সঙ্গে বেশি বেশি তরল খাবার দিতে হবে। ডেঙ্গুতে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট জরুরি। ডেঙ্গু রোগীদেরে প্লাটিলেট মাত্রা জানতে প্রতিদিনই রক্ত পরীক্ষা করতে হয়। তাই বাসায় থেকে চিকিৎসা নিলেও রক্ত পরীক্ষা ও তরল খাবারে গড়ে ১০ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। তবে এ বছর ডেঙ্গু রোগীরা ভাইরাসের একাধিক ভেরিয়েন্টের কারণে দ্রুত শকে চলে যাচ্ছে। তাই অনেক ক্ষেত্রেই বাড়িতে রেখে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা করা সম্ভব হচ্ছে না।
হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ অনেক বেশি হওয়ায় অনেক ডেঙ্গু রোগী ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের রোগীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বেশি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীরা সরকারি হাসপাতালে চিকৎসা নিলেও ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে, বেসরকারি হাসপাতালে এ ব্যয় দুই থেকে তিন গুণ গুণ বেশি। এখানে বেড ভাড়াসহ সব খরচ তুলনামূলক বেশি। আর ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট দেয়া বা আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হলে খরচ অনেক বেড়ে যায়।
আড়াই বছরের নিলীমা চৌধুরীর ডেঙ্গু চিকিৎসায় শিশু হাসপাতালে ৯ দিনে প্রায় ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান নিলীমার বাবা রণি চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৩০০ টাকার সিবিসি টেস্ট, ৭০০ টাকা বেড ভাড়া ও ৫০০-৭০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। একদিন ২৫০০ টাকার ওষুধ কিনতে হয়েছে।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ আহমেদুল কবির টিবিএসকে জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বারের মতো আক্রান্ত হওয়ার কারণে এ বছর সিভিয়ারিটি অনেক বেশি।
"এছাড়া ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত তিন দিন পর কমে যায়, তারপর হঠা'' ৫ দিনের দিন রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। জ্বর কমে গেলে বা না থাকলে রোগী ভেবে নেয় সুস্থ্য হয়ে গেছে। তখন ঠিকমত লিকুয়িড খাবার না খেলে, ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে না রাখলে রোগী শকে চলে যায়", বলেন তিনি।
"এ বছর ডেঙ্গুর ডেন ১, ৩ ও ৪ সেরোটাইপে আক্রান্ত হচ্ছে রোগীরা। সে কারণেও রোগী দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গু হলে বেশি বেশি করে লিকুয়িড খাবার খেতে হবে, প্রেশার কমছে কিনা তা দেখতে হবে আর বেশি বেশি বমি হলে, রক্তক্ষরণ হলে হাসপাতালে যেতে হবে," যোগ করেন তিনি।
২০২১ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে এক গবেষণার তথ্য বলছে একজন ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য গড়ে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা খরচ হয়।
'এপিডেমিওলজিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক বার্ডেন অব ডেঙ্গু ইন ঢাকা, বাংলাদেশ" শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর গড় খরচ ছিল ২২,৩৭৯ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালে ৪৭,২৩০ টাকা।
বিআইডিএস-এর স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক সরকার টিবিএসকে বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয় বহন করা কষ্টসাধ্য, তাদের মোট পরিবারিক আয়ের প্রায় ১৩৯% এ খরচ।
ডাঃ আব্দুর রাজ্জাক সরকার বলেন, ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ করতে কর্তৃপক্ষের উচিত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া, বিশেষ করে ডেঙ্গু সংক্রমণের মরসুম আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত।
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১১০ জন, যা ২২বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুসারে, রাজধানীতে ২,১৫৯ জন সহ মোট ৩,১৭৪ জন ডেঙ্গু রোগী এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০০০ সালে দেশে ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ৫৮ জন মারা গেছে। এরপর দীর্ঘদিন ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৫ এর নিচে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। সেসময় মারা গেছে ১৭৯ জন। ২০১৯ সালের পর চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে।
ডেঙ্গু চিকিৎসা দিতে তিনটি হাসপাতাল প্রস্তুত: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
ডেঙ্গু রোগী আরো বেড়ে গেলে তাদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা নর্থ সিটি কর্পোরেশন হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ'র নতুন হাসপাতাল ইউনিট এবং লালকুঠি হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে বৃহস্পতিবার এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ডেঙ্গু রোগী বেড়ে গেলে তাদের চিকিৎসা দেয়ার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে। তবে মনে রাখতে হবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিতে পারবে ঠিকই কিন্তু এডিশ মশা মারতে পারবে না। মশা মারার কাজ সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার।
"মশা কমলে ডেঙ্গু রোগীও কমে যাবে; হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপও কমে যাবে।"