কবিরাজ ছদ্মবেশে আত্মগোপন, ১৭ বছর পর গ্রেপ্তার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী
২০০৫ সালে বাগেরহাটে মনু বেগম নামে এক নারীর বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হেমায়েত ওরফে জাহিদ কবিরাজসহ ৫ জনকে আসামি করে ভুক্তভোগীর বোন বাদী হয়ে বাগেরহাট থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলাটির তদন্ত শেষে ২০০৯ সালে আদালত হেমায়েতকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন।
হত্যাকাণ্ডের পর মামলা দায়েরের পর থেকেই কবিরাজ ছদ্মবেশে বছর ধরে পলাতক ছিল সে। নিজেকে আড়াল করতে সে নাম পরিবর্তন করে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে।
তবে সম্প্রতি রাজধানীর কেরানীগঞ্জ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৩ এর একটি দল। বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি বলেন, হত্যা মামলা দায়েরের খবর পেয়ে সে পালিয়ে যশোরে একটি মাজারে আশ্রয় নেয়। পরে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে আজমীর শরীফ মাজারের উদ্দেশে রওনা করে। সেখানে সে কবিরাজি পেশাসহ বিভিন্ন ধরণের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ৩ বছর অবস্থান করে। ২০০৮ সালে আবারও অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ফিরে এসে ঢাকার মিরপুরে বসবাস শুরু করে। এসময় পরিচয় গোপনের জন্য লম্বা চুল-দাঁড়ির ছবি ব্যবহার করে আসল নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করে মো. জাহিদুল ইসলাম ছদ্মনামে নতুন এনআইডি কার্ড তৈরি করে। সে বিভিন্ন সময়ে একাধিক বিয়ে করে। মিরপুরে থাকাকালীন হেমায়েত কবিরাজির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করতে থাকে। মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের, স্বামী-স্ত্রীর কলহ দূরীকরণের, বশীকরণসহ বিভিন্ন রকমের তাবিজের নামে প্রতারণা করে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা হাতিয়ে নিতো সে।
র্যাব জানায়, গ্রেপ্তার হেমায়েত ১৫-১৬ বছর বয়স থেকে কবিরাজি শুরু করে। কবিরাজি পেশার মাধ্যমে সে নানাভাবে মানুষকে প্রতারিত করে টাকা আদায় করতো। তার বাবাও কবিরাজ ছিল। পারিবারিকভাবেই কবিরাজির বিভিন্ন পদ্ধতি ও কৌশল শিখে নেয় সে। মূলত নারীরাই ছিল তার প্রতারণার মূল টার্গেট। ২০০৩ সালে স্ত্রী-সন্তানসহ পিরোজপুর থেকে বাগেরহাটে এসে কবিরাজি ব্যবসা শুরু করে হেমায়েত। কবিরাজি পেশায় তার অন্যতম সহযোগী ছিল ওই হত্যা মামলার অপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি সোবহান।
২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে সোবহান ভিকটিম মনুর মাথাব্যথার রোগকে মানসিক রোগ আখ্যা দিয়ে চিকিৎসার জন্য হেমায়েতের কাছে নিয়ে আসে। কাপড়ের ব্যবসা এবং স্বামীর পাঠানো টাকা থেকে জমিয়ে মনুর কাছে লক্ষাধিক টাকা জমা হয়। এই টাকার দিকে হেমায়েতের দৃষ্টি পড়ে। মনুর সরলতার সুযোগে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাকে টার্গেট করে হেমায়েত।
হেমায়েত ভিকটিম মনুকে কিছু ভেষজ উপাদানের মাধ্যমে নিয়মিত ঘুমের চিকিৎসা দেওয়া শুরু করে। একপর্যায়ে সম্পত্তির দলিলপত্র এবং টাকা-পয়সা শত্রুপক্ষের জিনের আক্রমণে পড়তে পারে বলে ভয়-ভীতি দেখিয়ে নিরাপত্তার জন্য দলিলপত্র হেমায়েতের কাছে জমা রাখার জন্য মনুকে উদ্বুদ্ধ করে। নিয়মিত ভেষজ উপাদান সেবনের ফলে ভিকটিম মনুর ঘুম হয় এবং মাথাব্যথার সমস্যা কিছুটা কমে আসলে হেমায়েতের উপর ভিকটিমের আস্থা তৈরি হয়।
পরে ভিকটিম সরল বিশ্বাসে তার টাকা-পয়সা ও সম্পত্তির দলিল হেমায়েতের কাছে জমা রাখে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী হেমায়েত সহযোগীসহ মনুকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে দলিলপত্রে টিপসই নিয়ে তাকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে মনুর জ্ঞান ফিরলে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ করতে চাইলে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সোবহানের সহযোগিতায় হেমায়েত মনুকে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করে। এরপর লাশ বস্তাবন্দি করে হেমায়েতের বাড়ির সামনের খালের অপর পার্শ্বে ধানক্ষেতে লুকিয়ে রাখে।