প্রাথমিক লক্ষণে গুরুত্ব না দেওয়ায় স্ট্রোক থেকে বাড়ছে মৃত্যু ও অক্ষমতার হার
স্ট্রোক রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে সময়ই বেশি গুরুত্বপূর্ণ; দ্রুত চিকিৎসা শুরু, এমন রোগীদের মস্তিষ্কের ক্ষতির ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি মৃত্যুও ঠেকাতে পারে।
মস্তিষ্কের কোনো অংশে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হলে বা মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালী ফেটে গেলে সেই অবস্থাকে স্ট্রোক বা ব্রেইন অ্যাটাক বলা হয়। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে মস্তিষ্কের এই রোগ দীর্ঘমেয়াদী অক্ষমতা এবং মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।
স্ট্রোক রোগীর জন্য প্রথম সাড়ে চার ঘণ্টাকে বলা হয় 'গোল্ডেন আওয়ার'। স্ট্রোকের পর সঠিক সময়ে রোগীকে হাসপাতালে নিতে পারলে, শুধু ওষুধ দিয়েই রোগীকে সুস্থ্য করা সম্ভব। কিন্তু স্ট্রোক আক্রান্ত কিনা বুঝতে দেরি হওয়ায় অধিকাংশ সময় চিকিৎসকের কাছে রোগীকে নিতে দেরি হয় বলে স্ট্রোক রোগীদের অক্ষমতা ও মৃত্যু বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, "স্ট্রোকের পর প্রথম চার ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময়ের মধ্যে চিকিৎসা শুরু হলে বেশিরভাগ রোগীই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।"
"এমনকি, স্ট্রোকের ৬ থেকে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা গেলেও অনেক রোগীকে প্যারালাইসিস ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।"
তিনি আরও বলেন, রোগীরা স্ট্রোকে আক্রান্ত কিনা বুঝতে দেরি করে। অধিকাংশ স্ট্রোকের রোগী হার্ট অ্যাটাক মনে করে প্রথমে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে যায়।
"সেখান থেকে যখন স্ট্রোক জানতে পারে, তখন ঢাকা শহরের জ্যাম ঢেলে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঢাকা মেডিকেল বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে চিকিৎসা শুরু করতে অনেক দেরি হয়ে যায়। অনেক সময় হাসপাতালের প্রস্তুতির অভাবেও চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়," যোগ করেন তিনি।
ডাক্তার শফিকুল ইসলাম আরও জানান, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে চিকিৎসক, অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট এবং রোগীর আত্মীয়-স্বজনকে সচেতন হতে হবে, যাতে রোগীরা দ্রুত চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন।
'প্রিভেলেন্স অ্যান্ড রিস্ক ফ্যাক্টরস অফ স্ট্রোক ইন বাংলাদেশ: অ্যা নেশনওয়াইড পপুলেশন-বেজড সার্ভে' (বাংলাদেশে স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব এবং ঝুঁকির কারণ: দেশব্যাপী জনসংখ্যা-ভিত্তিক জরিপ) শীর্ষক এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব প্রতি হাজারে ১১.৩৯।
গবেষণায় স্ট্রোকের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ময়মনসিংহ বিভাগে এবং সবচেয়ে কম রাজশাহী বিভাগে। আরও দেখা গেছে, শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে স্ট্রোকের প্রকোপ বেশি।
৪০ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে স্ট্রোকের প্রাদুর্ভাব প্রতি হাজারে ৪.৬০। গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, বয়স্ক এবং পুরুষদের মধ্যে এই রোগের ব্যাপকতা অনেক বেশি।
দেশের ৮টি বিভাগ এবং ৬৪টি জেলার ২৫ হাজার ২৮৭ জনের ওপর পরিচালিত সমীক্ষাটি ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সায়েন্সডিরেক্ট জার্নালে প্রকাশিত হয়।
সড়ক দুর্ঘটনা এবং হৃদরোগের পর বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল হেলথ এস্টিমেটস (জিএইচই) রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার ১৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে; মৃত্যুর হার ছিল প্রতি একলাখে ৮২.৩ জন।
২০১০ সালে স্টোকে মারা গেছেন ১ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৫ জন। জিএইচই অনুসারে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা ১৩.৭ শতাংশ বেড়েছে।
বিএসএমএমইউ-এর নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও সার্জারি অনুষদের ডিন ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, কথা বলতে অসুবিধা, মাথা ঘোরা, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা, মুখ বাঁকা হয়ে যাওয়া এবং হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া স্ট্রোকের লক্ষণ।
"স্ট্রোক নির্মূল করা যায় না, তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। স্ট্রোকের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীকে অবিলম্বে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। স্ট্রোকের রোগীকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করার পর যেকোনো এমবিবিএস ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মৃত্যুহার ও রোগীর অক্ষমতা হ্রাস করতে পারেন," যোগ করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, তবে বাংলাদেশে স্ট্রোক রোগীদের চিকিৎসার জন্য গোল্ডেন আওয়ার ব্যবহারের সুযোগ খুবই কম।
স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে জীবনযাপন, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, ধূমপান না করা, শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা, চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা এবং খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত ফল ও সবজি রাখার মাধ্যমে স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যেতে পারে বলে উলেখ করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ হোসেন
আজ ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। এ বছর বিশ্ব স্ট্রোক দিবসের থিম হল '#প্রেশাসটাইম', যার বাংলা অর্থ মূল্যবান সময়। স্ট্রোক নিয়ে সচেতনতাকে আরও জোরালো করতে আগের বছরের মতো এ বছরও কাজ করছে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন (ডব্লিউএসও)।