বস্তির বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি
রাজধানীর কল্যাণপুর পোড়া বস্তির ৮নং বস্তিতে থাকেন হকার আব্দুস সামাদ। তার ঘরটির পাশেই রয়েছে একটি পরিত্যক্ত ডোবা। যেখানে নিয়মিতই বস্তির লোকজন বর্জ্য ফেলে দূষিত করে রেখেছে। একদিকে দুর্গন্ধ আবার ডোবার নোংরা পানিতে জন্ম নেওয়া মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ থাকেন বস্তিবাসী। আব্দুস সামাদ নিজেও প্রায় ৬ দিন ধরে জ্বরে ভুগছেন।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে আব্দুস সামাদ বলেন, "আমাদের তো আর থাকার জায়গা নেই। এখানেই ছোট একটি রুম ২০০০ টাকায় ভাড়া নিয়ে দুই সন্তান নিয়ে থাকি। প্রায় এক সপ্তাহ ধরে গায়ে জ্বর থাকলেও ডাক্তারের কাছে যেতে পারছি না। দোকান থেকে প্যারাসিটামাল এনে খেয়েছি কিন্তু জ্বর কমেনি।"
তিনি বলেন, "তিন বেলা খাবারই খেতে পারছি না আবার ডাক্তারের কাছে যাবো কিভাবে? সরকার নাকি বস্তিবাসীর জন্য অনেক কিছু করে কিন্তু আমরা তো কিছু পেলাম না। বাসার পাশের ডোবা পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশনের লোকজন পরিষ্কার করে না। বাসা থেকে ময়লা নেয় প্রাইভেট একটি কোম্পানি কিন্তু আশপাশের ডোবা, ড্রেন পরিষ্কার করে না সিটি কর্পোরেশন। মাসে একবার মশার ওষুধ দেয় কিন্তু তাতে মশা মরে না।"
কল্যাণপুরের ৪ নং বস্তির বাসিন্দা হাফসা বেগম টিবিএসকে বলেন, "আমাদের কেউ মানুষ বলে মনে করে না। বস্তির মধ্যে বর্জ্য তো আছেই, এছাড়া আশেপাশের এলাকার বর্জ্যও বস্তির কাছে এনে ফেলা হয়। মশার ওষুধও দেওয়া হয় না নিয়মিত। পচা গন্ধ আর স্যাঁতস্যাতে স্থানেই থাকতে হয়।"
শুধু আব্দুস সামাদ আর হাফসা বেগমই নয়, কল্যাণপুরের অধিকাংশ বস্তিবাসীর অভিযোগই এমন। বর্জ্য অব্যবস্থাপনার কারণে বস্তি এলাকার মানুষ যেমন বসবাসের ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহাচ্ছে তেমনি স্বাস্থ্যগতভাবেও বেড়ে উঠছে নানা রোগব্যাধি নিয়ে।
সম্প্রতি রাজধানীর কল্যাণপুর পোড়া বস্তি ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ বস্তিতেই এখনও গড়ে ওঠেনি সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। কিছু কিচেন বর্জ্য সংগ্রহ করলেও অধিকাংশ বর্জ্যই আশেপাশের ড্রেন ও জলাধারগুলোতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। এমনকি রাস্তার পাশেও স্তুপ হয়ে থাকছে বর্জ্য।
নিজ উদ্যোগে পৌঁছে দিতে হয় গৃহস্থালির ময়লা। ফলে বস্তিতেই থেকে যাচ্ছে অনেক আবর্জনা। সেগুলো আবার নানা স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ছে। এমন অব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন বস্তির বাসিন্দারা। পাশাপাশি পানি ও বায়ুবাহিত রোগসহ নানা জটিল রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। এসব রোগজীবাণু শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নগরবাসীর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বস্তির বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে পানি ও বায়ু দূষিত হবে। দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি ক্ষতিকারক গ্যাসও তৈরি হবে। ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যাসহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকবেন বস্তি ও শহরের বাসিন্দারা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে বস্তি খানায় বসবাসরত জনসংখ্যা ১৮ লাখেরও বেশি। ঢাকা বিভাগে সর্বোচ্চ ৮ লাখ ৮৪,৪৯৬ জন বস্তিবাসী রয়েছে।
বিবিএসের পরিচালিত সর্বশেষ ২০১৪ সালের বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোক গণনা রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে মোট বস্তির সংখ্যা ১৩ হাজার ৯৩৫। বস্তিখানার সংখ্যা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৬১। এসব বস্তিতে এখন সাড়ে ২২ লাখ মানুষ বসবাস করছে। বস্তিখানার মধ্যে সিটি করপোরেশন এলাকায় রয়েছে ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৫৬টি।
তবে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, শুধুমাত্র ঢাকা শহরে পাঁচ হাজারের বেশি বস্তিতে অন্তত ৪০ লাখ মানুষ বাস করছে। এসব বস্তিতে থাকা মানুষ দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন।
বস্তিবাসী বিভিন্ন রোগশোকে ভুগলেও একেবারে সংকটাপন্ন না হলে সাধারণত ডাক্তারের সংকটাপন্ন হন না। নির্ভর করেন স্থানীয় ফার্মেসীর উপর।
কল্যাণপুর বস্তির বাসিন্দা নাসিমা বেগম টিবিএসকে বলেন, "চার বছর আগে গলায় টিউমার ধরা পড়লেও টাকার অভাবে অপারেশন করতে পারছি না। বড় অসুস্থতা না হলে ফার্মেসী থেকে ওষুধ এনে খাই। কয়েকটি এনজিওর কর্মীরা মাঝে মাঝে আসলেও তারা তো কোনো চিকিৎসা দেয় না।"
তিনি আরও বলেন, "বাসা-বাড়িতে কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চালানো দায়। এক ছেলে ও দুই মেয়ে কাউকেই পড়াতে পারছি না। পড়াশুনা কেমনে করামু? নিজেরাই খেতে পারি না। মেয়ে বড়টা ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর পরে আর পড়াতে পারিনি। গত বছর পড়াশোনা বন্ধ করে দেই।"
বস্তির সামিত ফার্মেসীর মো. শাহিন টিবিএসকে বলেন, "বস্তিবাসীরা অধিকাংশই কোনো ধরনের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ কিনতে আসেন। আবার এসে রোগের কথা বললে সে অনুযায়ী ওষুধ দেই। বড় কোনো সমস্যা হলে হাসপাতালে যেতে বলি। এখানে জ্বর, সর্দির ওষুধই বেশি নিতে আসে।"
পরিবেশ আন্দোলন কর্মী ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল টিবিএসকে বলেন, "ঢাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে তার বড় একটি অংশ অব্যবস্থাপনা হয়। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বস্তিবাসী। কারণ বস্তিগুলো একটু নিচু স্থানে হওয়ায় আশপাশের বর্জ্য বস্তির পাশে ফেলা হয়। এজন্য অবশ্যই সিটি কর্পোরেশন দায়ী।"
তিনি আরও বলেন, "বস্তিতে বর্জ্যের কারণেই অধিকাংশ বস্তিবাসী বিভিন্ন রোগে ভোগেন। এর সঠিক সমাধান হচ্ছে বস্তি এলাকায় যারা বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যুক্ত তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা।"
ঢাকা কলিং প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, নোংরা পরিবেশের কারণে প্রায় ৩৪ শতাংশ বস্তিবাসী নানা ধরনের সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হন। ময়লা পানির কারণে ২৭ শতাংশ মানুষ ও জলাবদ্ধতার কারণে ১৯ শতাংশ মানুষ এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারেন।
এতে বলা হয়, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার ফলে পরিবেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। জ্বর, সর্দি, মাথাব্যথা, চর্মরোগ, প্রস্রাবে সংক্রমণ ও জ্বালাপোড়াসহ কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সার, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড রোগের মতো বিপজ্জনক রোগের বিষয়টিও গবেষণায় উঠে এসেছে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান টিবিএসকে বলেন, "ঢাকার মানুষের প্রায় ৩০% মানুষ কোনো না কোনো বস্তিতে বসবাস করে। আবার অধিকাংশ বস্তিই তৈরী হয়েছে নিচু স্থানে বর্জ্য ফেলে। এজন্যও বর্জ্য বড় একটি সমস্যা বস্তিবাসীর। নিম্ন আয়ের মানুষকে বস্তিতে রাখলে তাদের জীবনমান উন্নয়ন সম্ভব নয়। ধানমন্ডি, মোহাম্মদ ও পূর্বাচলের মতো জায়গায় সরকারিভাবে বস্তিবাসীর জন্য আবাসন থাকা উচিত। নতুন ইকোনোমিক জোনগুলোতেও নিম্নআয়ের মানুষের জন্য বাসস্থানসহ সকল সুবিধা দিলে যেমন বস্তিবাসীর জীবনমান উন্নত হবে তেমনি সমস্যাও সমাধান হবে।"
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, "বস্তির নিম্নবিত্ত মানুষেরা বেশি পানিবাহিত রোগে শিকার হচ্ছেন। বস্তির বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে বস্তিবাসী। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়, পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শক্তিশালী তদারকি ব্যবস্থা ও জবাবদিহি এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বর্জ্যের কারণে জনস্বাস্থ্যের সমস্যাগুলো নিরূপণ করে তা সমাধানে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।"
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, "বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের সেহেতু বস্তিগুলোর বর্জ্য তাদের সংগ্রহ করা উচিত। বর্জ্য পানির সাথে মিশে গেলে শুধু বস্তির না, নগরবাসী সবাইকেই ভোগাচ্ছে। বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করা যাবে না, পাশাপাশি যতদিন তাদের জন্য বিকল্প না ব্যবস্থা হয় ততদিন তারা সেখানে থাকতে পারবেন এ মর্মে রিপিটেড হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। সে মোতাবেক বস্তির বাসিন্দারা দুই সিটি কর্পোরেশনের সব সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে।"
এ নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, "বেশিরভাগ বস্তির ময়লা আবর্জনা সরানো হচ্ছে না। ফলে সেখানকার বাসিন্দারা নানান রোগে ভুগছেন। পাশাপাশি সেসব রোগও অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। সর্বোপরি বস্তির ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনকে আন্তরিক হতে হবে।"
বস্তির উন্নয়নে বস্তিবাসীদের সম্পৃক্ত করার পরামর্শ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খানের।