ইউরি রেডকিন: থেকে গেলেন বাংলাদেশেই
ইউরি রেডকিনকে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য প্রাণ বিসর্জন না দিতে হলে এই রোববার (১৮ ডিসেম্বর) তাঁর বয়স হতো ৭১ বছর। ১৯৫১ সালের এই দিনেই সুদূর রাশিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন মাতৃভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, আমাদের এই দেশে। চট্টগ্রামে শেষ নিদ্রায় তিনি শান্তিতে ঘুমাচ্ছেন কর্ণফুলীর মোহনায়, রেডকিন পয়েন্টে।
১৯৭১ এর ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধের নৌ কমান্ডো দামাল ছেলেদের অপারেশন শুরু হয় অপারেশন জ্যাকপট দিয়ে। চট্টগ্রাম বন্দরে ডুবতে থাকে পাকিস্তান ও তাদের সহযোগীদের জাহাজ। কর্মক্ষমতা কমতে থাকে বন্দরের।
একই অবস্থা সৃষ্টি হতে থাকে মোংলা, চালনা, নারায়ণগঞ্জ, গোদনাইল, বরিশাল, দাউদকান্দিসহ সকল সমুদ্র ও নদীবন্দরে। দখলদার পাক বাহিনীর পরিবহন ব্যবস্থা হয়ে পড়ে সীমিত।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে অবধারিত পরাজয়ের মুখামুখি হয়ে বর্বর পাক বাহিনী চট্টগ্রামসহ সকল বন্দর মাইন দিয়ে ছেয়ে দেয়, যাতে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য পেতে দেরি হয়।
এই নাজুক অবস্থায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ এর মার্চে মস্কো সফরকালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর মাইন ও ডুবে থাকা জাহাজ পরিষ্কার করে কার্যোপযোগী করে তোলার জন্য সহযোগিতা চান।
একই সহযোগিতা তিনি জাতিসংঘের কাছেও চেয়েছিলেন। তারা রাজিও হয়েছিল। তবে ব্যবস্থা নিতে অনেক সময় লাগবে বলে জানিয়েছিল।
বন্ধুপ্রতিম সোভিয়েত সরকার সেই মার্চ মাসের মধ্যেই চুক্তি সই করে ১৯৭১ এর ২ এপ্রিল রিয়ার এডমিরাল সের্গেই জুয়েনকোর নেতৃত্বে ১০০ জনের প্রথম দল পাঠিয়ে দেয়। শুরু হয় উদ্ধার অপারেশন।
এপ্রিলের মধ্যেই প্রায় ১০০০ নাবিক ও ২৪টি বিভিন্ন প্রকৃতির জাহাজ নিয়োজিত হয় রেসকিউ মিশনে। তিন মাসের মধ্যেই প্রায় অচল বন্দরের একটি চ্যানেল চালু হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে দুর্ভিক্ষ ও সংকট থেকে বাঁচাতে নির্বিঘ্নে আমদানি হতে থাকে খাদ্য ও অন্য সামগ্রী।
১৯৭৩ সালের মধ্যেই বন্দর তার স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের জলসীমা হয় মাইনমুক্ত। ২৬টি ডুবে থাকা জাহাজ তুলে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়।
১৯৭৪ এর জুনে সোভিয়েত নাবিকদের নিয়ে দেশে ফেরেন এডমিরাল সের্গেই জুয়েনকো কিন্তু মায়ের কোলে ফিরতে পারেননি একজন। তিনি ২২ বছরের টগবগে যুবক ইউরি রেডকিন।
১৯৭৩ এর ১৩ জুলাই কর্মরত অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁকে সমাহিত করা হয় কর্ণফুলীর মোহনায়। সেখানেই সুসজ্জিত কবরে তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত। জায়গাটি বাংলাদেশ নেভাল একাডেমির আওতায় হওয়ায়, সেখানে জনগণের অবাধ যাতায়াত সম্ভব নয়।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও রাশিয়ার চট্টগ্রামস্থ অনারারি কনসাল স্থপতি আশিক ইমরানের উদ্যোগে পরবর্তীতে লালদীঘি প্রাঙ্গনে প্রয়াত রেডকিনের স্মরণে স্থাপিত হয় এক দৃষ্টিনন্দন সৌধ।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পর আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি আত্মত্যাগী, সাহসী এই ভিনদেশী নাবিককে।
ঘুমাও শান্তিতে ইউরি রেডকিন। সালাম তোমায়!