চলতি মাসে শুধু মেট্রোরেলই চালু হচ্ছে; বিআরটি, এক্সপ্রেসওয়ে চালু হতে পারে আগামী বছর
অন্তত তিনটি মেগাপ্রকল্প আংশিক বা পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার মাধ্যমে– বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে রাজধানী ঢাকার গণপরিবহন দৃশ্যপটও গৌরবময় হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু, বিভিন্নভাবে ব্যাহত হওয়ার ফলে গৌরবের পালকগুলি যুক্ত হতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
গণপরিবহন মেগাপ্রকল্পগুলোর মধ্যে– আগামী ২৮ ডিসেম্বর আংশিকভাবে চালু হচ্ছে ঢাকা মেট্রোরেল। অন্যদিকে, ২০২৩ সালের মার্চে আংশিকভাবে চালু হওয়ার কথা রয়েছে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের (উড়াল সড়ক)। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) চালুর সময়সীমা পিছিয়ে আগামী বছরের জুনে করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আগামী বুধবার কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত পরিকল্পিত দেশের প্রথম মেট্রোরেল সেবার উদ্বোধন করবেন। সেই সুবাদে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার পথে মেট্রোরেলের গতিময় যাত্রা আপাতত উপভোগের সুযোগ পাবেন যাত্রীরা।
তবে বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়িতে করে যেতে তাদের আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে।
প্রকল্পের অগ্রগতির প্রতিবেদন অনুসারে, এটি মার্চে চালুর কথা থাকলেও, এই লক্ষ্যমাত্রার সাথে তাল মেলানোর মতো জোরালো হয়নি ভৌত বাস্তবায়ন কাজ।
ডিসেম্বর নাগাদ প্রায় ২০ কিলোমিটার বিআরটি প্রকল্প যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কতৃপক্ষ; কিন্তু, এপর্যন্ত চালু হয়েছে কেবল ২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের একটি ফ্লাওভার। যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বিআরটি সড়ক নির্মাণ কাজের কারণে সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া রাস্তা আরও দীর্ঘায়িত করবে এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ব্যস্ত মহাসড়কে চলাচলকারীদের দুর্ভোগ।
এক্সপ্রেসওয়ের কোনো কাজই মসৃণ নয়
এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধনের সময়সীমা পরিবর্তন এবারই প্রথম নয়।
২০১৯ সালের জুনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) চলমান এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হলে– এটি দিয়ে মগবাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যান চলাচল শুরু হবে।
২০১১ সালে প্রকল্পটি পিপিপি ভিত্তিতে বাস্তবায়নের প্রস্তাব নীতিগত অনুমোদন দেয় অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি (সিসিইএ)। এ বিষয়ে ইথাল থাই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সই হয় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে।
প্রকল্পের বিমানবন্দর থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার অংশটি চালুর সময়সীমা পিছিয়ে এই বছরের ডিসেম্বরে করা হয়, কিন্তু, সাম্প্রতিক অগ্রগতি প্রতিবেদনে তা আবারো পেছানো হয়েছে।
১৯.৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই এক্সপ্রেসওয়ের কাজ তিন পর্যায়ে বিভক্ত; এরমধ্যে এয়ারপোর্ট থেকে বনানী পর্যন্ত অংশের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ। অন্যদিকে, বনানী রেল ক্রসিং থেকে মগবাজার পর্যন্ত দ্বিতীয় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মগবাজার থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত অংশের কাজ ২০২২ সালের মার্চে সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।
কয়েক বছর আগে পরিকল্পনা করা হলেও, ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম এই এক্সপ্রেসওয়ের ভৌত কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। ঢাকার কেন্দ্রস্থলে যানজট কমানোসহ দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলা থেকে আসা যানবাহনকে দ্রুত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্য রেখে উড়াল সড়কটির নকশা করা হয়।
দেশের প্রথম এই উড়াল সড়কে প্রধান বিনিয়োগকারী ইথাল থাই কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি থাইল্যান্ডের মুদ্রায় (বাথ) গতবছরে এ প্রকল্পে ২৩১.৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে।
কোম্পানিটির মোট ৬,৫২৭ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা থাকলেও, গত এক বছরে তার মাত্র ৩.৫৪% ছাড় করেছে।
ইথাল থাই কোম্পানির অনিরীক্ষীত আর্থিক প্রতিবেদন বলছে, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় উড়াল সড়ক নির্মাণে প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ করেছে ৩২০.১১ কোটি থাই বাথ যা প্রায় ৮১৩.৬৫ কোটি টাকার সমান। পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নে কোম্পানিটি এপর্যন্ত তাদের প্রতিশ্রুত ৬,৫২৭ কোটি টাকার মাত্র ১২.৪৭% ছাড় করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের ভিত্তি স্থাপন করার পর অর্থায়ন সংকটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে কাজ শুরু করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থাটি।
পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যালিডিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিএইচএফ) হিসেবে ২,৪১৩ কোটি টাকার অনুদান দেওয়ার পর কাজ শুরু করে তারা। এছাড়া, চীনা ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি শেয়ার বিক্রি করেও অর্থ সংগ্রহ করে। পাশাপাশি চীনের দুটি ব্যাংক- চায়না এক্সিম ব্যাংক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অভ চায়নার (আইসিবিসি) ৮৬১ মিলিয়ন ডলারের ঋণ গ্যারান্টির আবেদন করে।
দ্বিতীয়বার ব্যাহত হওয়ার কারণ
ইথাল থাই কোম্পানি চলতি বছরেই উড়াল সড়কটি চালু করা যাবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলেও, এই লক্ষ্যপূরণও ব্যর্থ হয় বিনিয়োগের অভাবে।
প্রতিষ্ঠানটির দাবি, ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধি ও সরবরাহ অপ্রতুলতার কারণে বাস্তবায়নের গতি কমে এসেছে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে কিছুদিন কাজ বন্ধ থাকাকেও এই দেরির আরেক কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
আগামী বছরের মার্চের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষে যানবাহনের জন্য খুলে দেয়ার লক্ষ্যে কাজ চলছে বলেও সরকারের পিপিপি অফিসসহ বিভিন্ন দফতরে পাঠানো অগ্রগতি প্রতিবেদনে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সরকারের সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব কর্তৃপক্ষ (পিপিপিএ)'র ডিরেক্টর জেনারেল (প্রোগ্রামিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট প্রোমোশন) মো. আবুল বাশার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, বাস্তবায়ন অগ্রগতির হার পর্যায়ক্রমে বাড়ছে। এর আগে কাজের গতি ব্যাহত হওয়ার ফলে বিমানবন্দর-তেজগাঁও অংশ জুনে খুলে দেওয়া হবে।
তিনি আরও জানান, প্রকল্পেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। পান্থকুঞ্জ, হাতিরপুল হয়ে পলাশী পর্যন্ত নতুন একটি লাইনও যোগ হচ্ছে।
প্রথম অংশের অগ্রগতি ৮৯.৫৪%
থাইল্যান্ডের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইথাল থাই কোম্পানির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের বা বিমানবন্দর থেকে বনানী অংশের ৭.৪৫ কিলোমিটার উড়াল সড়ক নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে ৮৯.৫৪ শতাংশ। আগের বছরের একই সময়ে এই অংশের অগ্রগতি ছিল ৬৭.৯৫ শতাংশ। এই হিসাবে প্রথম অংশের অগ্রগতি এক বছরে বেড়েছে ২১.৫৯ শতাংশীয় পয়েন্ট।
তবে প্রকল্পের দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশের নির্মাণে এই সময়ে তেমন অগ্রগতি হয়নি বলে প্রতিবেদনটিতে উঠে এসেছে। এছাড়া, কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ভবন নির্মাণে অগ্রগতি হয়েছে ৭৪ শতাংশ।
তেজগাওঁ রেল স্টেশনের সামনে রেললাইনের সমান্তরালে স্থাপন করা প্রকল্পের কনস্ট্রাকশান ইয়ার্ডে অনেকটাই বেকার পরে আছে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি ও নির্মাণ উপকরণ। হাজারের বেশি শ্রমিকের সরব উপস্থিতিতে মুখর এই ইয়ার্ডে এখন শুধু কাজ করছেন কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী।
গত দুই মাসের বেশি সময় ধরে প্রকল্পের তেজগাঁও অংশে কাজ প্রায় বন্ধ আছে বলে জানান তাদের একজন।
নিরাপত্তা কর্মীরা বলছেন, মজুরি পরিশোধে জটিলতার কারণে সেপ্টেম্বরে তেজগাঁও এলাকায় প্রকল্পের শ্রমিকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এর পরে পাওনা পরিশোধ করে শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়ার পর তেজগাঁও এলাকায় আর কোনো কাজ হয়নি। কারওয়ান বাজার এলাকায় রেললাইনের দুই পাশে কিছু পিলার স্থাপন করা হলেও ভায়াডাক্ট স্থাপন করা হয়নি।
বিআরটি আগামী বছরের ডিসেম্বরে
২০১৬ সালের মধ্যে কাজ শেষ করতে ২০১২ সালে ২,০৪০ কোটি টাকা ব্যয় ধরে অনুমোদন করা হয় বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি প্রকল্প। তারপর থেকে দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধির ফলে এই প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৪,২৬৮.৩৩ কোটি টাকায়। চলতি ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার সর্বশেষ সময়সীমা বেধে দেয়া হয়েছিল।
সঠিক পরিকল্পনায় সময়মতো কাজ শেষ হলে গাজীপুর থেকে বিমানবন্দরে যাতায়াতের সময়– আড়াই ঘন্টা থেকে নেমে আসত ৪৫ মিনিটে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশের বেশি শেষ হয়েছে। কাজ শেষ করতে প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে আগামী জুনের মধ্যে সব কাজ শেষ করে বিআরটি চালু করা সম্ভব হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।
প্রকল্পটির সড়ক অংশের পরিচালক এএসএম ইলিয়াস শাহ বলেন, শেষবারের মতো এক বছর মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এর পরে আর সময় বৃদ্ধির আবেদন করা হবে না। উপযুক্ত প্রস্তুতির অভাব আর ত্রুটিপূর্ণ ডিজাইনের কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সময়মতো শেষ হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
মেট্রোরেল আংশিক চালু হচ্ছে
উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দেশের প্রথম মেট্রোরেল চালু করতে এমআরটি লাইন-6 প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে ২০১২ সালের পহেলা জুন থেকে। প্রকল্পের কাজ শেষ হলে যাত্রীরা ৩৮-৪০ মিনিটে এই ২০.১৬ কিলোমিটার রাস্তা পারাপার করতে পারবেন। দৈনিক যাত্রী পরিবহন করা যাবে প্রায় ৫ লাখ।
২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ থাকলেও ২০১৯ সাল থেকেই প্রতি বছরের ডিসেম্বরে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার মেট্রোরেল চালুর লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করা হচ্ছে। টানা তিন বছরের ব্যর্থতা শেষে এবার আংশিক চালু হচ্ছে- মেট্রোরেল। অবশ্য শেষ পর্যায়ে এসে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রো লাইনটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে ২১.২৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল চালু হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।