চলন বিলের সাথে সংযুক্ত ৮টি নদীই এখন মৃতপ্রায়: বাপা
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলন বিল এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার নামে রাস্তা, রেগুলেটর এবং স্লুইস গেইট দিয়ে এ বিলের সাথে সংযুক্ত বড়াল নদীসহ ৮টি নদীই প্রায় মেরে ফেলা হয়েছে।
শনিবার দেশের নদী, হাওর ও বিলের সমস্যাবলী উপজীব্য করে দু'দিনের পরিবেশ সম্মেলনের শেষ দিনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে একথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের লক হ্যাভেন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী মোতাহার হোসেন ভবনে বাংলাদেশের হাওর, নদী ও বিল নিয়ে সমস্যা ও প্রতিকার বিষয়ক বিশেষ সম্মেলনের আয়োজন করে পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্ক (বেন)।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে বেনের বৈশ্বিক সমন্বয়ক মো. খালেকুজ্জামান বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় চলন বিল বড়াল নদীর প্রায় ২৩০ বর্গকিলোমিটারের অববাহিকায় অবস্থিত যা কিনা জীববৈচিত্র্যে ভরপুর একটি অনন্যসাধারণ অঞ্চল ছিল। উন্নয়ন, সেচ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার নামে রাস্তা, রেগুলেটর এবং স্লুইস গেইট দিয়ে এই বিলটিকে খণ্ডিত করা হয়েছে। এ বিলের সাথে সর্বমোট ৮টি নদী সংযুক্ত ছিল, যা এখন প্রায় মৃত।
সম্মেলনে বক্তারা বলছেন, দেশের হাওর ও উপকূলে অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বন্যা ও জলাবদ্ধতার সমস্যা বাড়ছে। তাই উন্নয়ন প্রকল্প করার ক্ষেত্রে নদী-জলাশয় ও হাওরের পরিবেশ এবং প্রকৃতিকে মাথায় রাখতে হবে।
গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা করে মো. খালেকুজ্জামান বলেন, হাওর এলাকায় আগে মে মাসে বেশি বৃষ্টি হতো। বৃষ্টি শুরুর আগেই সেখানকার একমাত্র ফসল বোরো ধান পেকে যেত। ফলে কৃষকের ক্ষতি হতো না। এখন এপ্রিলে বৃষ্টি বাড়ছে। ফলে ধান পাকার আগে বন্যা এসে তা ডুবিয়ে দিচ্ছে। ৩০ শতাংশ জায়গা ফাঁকা রাখা দরকার হলেও বর্তমানে আড়াই শতাংশ আছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, বাপার দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে আংশিক অবমুক্ত হলেও এখনো পুরোপুরি দখল ও দূষণমুক্ত হয়নি চলন বিল। বড়াল নদীর উপর থেকে সকল কংক্রিট রেগুলেটর এবং স্থাপনা অপসারণ করে এবং প্রয়োজনীয় খনন ও সংস্কার সাধনের মাধ্যমে বড়াল নদীকে সম্পূর্ণ মুক্ত করার দাবি এলাকার জনগণের। চলন বিলের মধ্য দিয়ে সকল সড়ক ও মহাসড়ক পিলারের উপর নির্মাণ করতে হবে যেন এই বিলে পানির প্রবাহ উন্মুক্ত থাকে।
মো. খালেকুজ্জামান বলেন, দেশের সাতটি জেলায় হাওর রয়েছে। দেশের আয়তনের ১৪% হাওর এবং হাওর দেশের ১৬-২০% ধান, ২৮% মাছ ও অন্যান্য খাদ্যশস্যের যোগান দেয়। প্রতিবেশগতভাবে সুন্দরবনের পরেই হাওরের স্থান। কিন্তু বিভিন্ন উন্নয়নের নামে আমরা হাওরের প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করছি।
হাওরের সুবিধা উল্লেখ করে মূল প্রবন্ধে বলা হয়, হাওর অবারিত জলরাশি, বিস্তীর্ণ খোলা অঞ্চল ইকো-ট্যুরিজমের জন্য উপযুক্ত। কৃষি, মৎস, হাঁস-মুরগি, পশু-প্রাণী এবং পানি সম্পদ-ভিত্তিক শিল্প উন্নয়নের অবারিত সুযোগ এখানে।
সুপারিশ হিসেবে বলা হয়, অকাল বন্যার প্রকোপ থেকে ফসল রক্ষা এবং নাব্যতা বাড়ানোর জন্য সঠিকভাবে সার্ভে করে ড্রেজিং এর মাধ্যমে প্রস্থচ্ছেদ বাড়ানো জরুরী। পরিবর্তিত জলবায়ুর সাথে মিল রেখে সঠিক বোরো ধানের জাত এবং রোপণের সময়কাল নিয়ে আরো বেশি গবেষণা হওয়া জরুরী এবং সে মোতাবেক কার্যকর ব্যবস্থাপনা করা সময়ের দাবি। জাতিসংঘের পানি প্রবাহ আইনের (১৯৯৭) আওতায় পানি-পলি-নদী-ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ নেওয়া বাংলাদেশের জন্য জরুরী।
সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, দেশের হাওর অঞ্চলে এখন থেকে আর কোনো রাস্তা নির্মাণ করা হবে না। সেখানকার ভূমিরূপ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে সরকার একটি উড়াল সড়ক নির্মাণ করছে। আরেকটি উড়াল সড়কও নির্মাণ করা হবে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মো. মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, দেশের নদ-নদীগুলোর দখলদারদের চিহ্নিত করে নদী রক্ষা কমিশন তালিকা প্রকাশ করেছে। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে ওই তালিকা অনুযায়ী দখলদারদের উচ্ছেদ করা। যাতে নদীগুলো তাদের স্বাভাবিক প্রবাহে চলতে পারে।
বেনের প্রতিষ্ঠাতা ও বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় একসময় অষ্টমাসী বাধ ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। মাসের আট মাস বাধ দিয়ে ফসল করা হতো, বাকি সময় তা কেটে দিয়ে পানি প্রবেশ করতে দেওয়া হতো। কিন্তু বিদেশি পরামর্শকদের বুদ্ধিতে সরকার উপকূলজুড়ে স্থায়ী বাধ নির্মাণ করেছে। যার ফলাফল হিসেবে আজকে দেশের উপকূলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে।
বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ঢাকাসহ দেশের বড় শহরগুলোতে যেসব খাল রয়েছে, তা উন্নয়ন প্রকল্পের নামে আরও সরু করা হয়েছে। তার চারপাশে দখলদারদের বৈধতা দেওয়া হয়েছে। হাওরের দখল ও দূষণ বন্ধ করতে না পারলে আমাদের রাজধানীসহ বড় শহরগুলো বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।