চিকিৎসক সংকটে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ৬টি হাসপাতাল
১৮৭০ সালে নীলফামারীর সৈয়দপুরে দেশের বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে সময় রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য সৈয়দপুরে আউটডোর সেবাসহ ৯০ বেডের রেলওয়ে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন হাসপাতালে রোগীদের ভিড় লেগেই থাকত এবং চিকিৎসাসেবার মানও ছিলো উন্নতমানের। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। চিকিৎসক, নার্স ও ফার্মাসিস্টের সংকটে হাসপাতালটি ধুঁকে ধুঁকে চলছে।
চিকিৎসক, নার্স ও ফার্মাসিস্ট না থাকায় প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো এই হাসপাতালে রোগী ভর্তি হয় না বললেই চলে। ফলে রোগীর অভাবে হাসপাতালটির বেডগুলো এখন ধূলায় ধূসরিত।
বর্তমানে এই হাসপাতালে চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেশিরভাগ কক্ষই তালাবদ্ধ। আগে ৯০ শয্যা থাকলেও বর্তমানে ৮২ শয্যার বিশেষায়িত এই হাসপাতালের দিনে হাতেগোনা কয়েকজন রোগী আসে চিকিৎসাসেবা নিতে।
হাসপাতালের অবকাঠামো, অপারেশন থিয়েটার, এক্সরে রুম, সার্জারি ওয়ার্ড, সাধারণ ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, কেবিনসহ চিকিৎসার যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল না থাকায় একসময়ের রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী আর যাত্রীদের চিকিৎসাসেবার ভরসাস্থল এই হাসপাতালটিতে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেই। ব্যবহার না হওয়ায় নষ্ট হওয়ার পথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সব যন্ত্রপাতি।
রেলওয়ে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালে ১৫০টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৬২ জন। হাসপাতালটিতে ৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন ২ জন, ১০ জন নার্সের বিপরীতে ৪ জন এবং ৯ জন ফার্মাসিস্টের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৩ জন।
হাসপাতালটিতে নেই কোনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, রয়েছে ওষুধের স্বল্পতাও। মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। পুরোপুরি বন্ধ পরীক্ষা-নিরীক্ষাও। মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা। ফলে রেলের বর্তমান ও অবসরে যাওয়া কর্মচারী ও পোষ্যরা হাসপাতালমুখী হচ্ছেন না।
তবে সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালের বিভাগীয় মেডিকেল অফিসার ডা. আনিছুল হক বলেন, হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। হাসপাতালের ইনডোরেও রোগী ভর্তি হয়। প্যাথলজির পরীক্ষা না হলেও এক্সরে ও ইসিজি করা হয়। ছোটখাট সার্জারী হয়, হাসপাতালে রোগীও ভর্তি হয়।
সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালের চেয়েও দুরবস্থা পশ্চিমাঞ্চল রেলের অন্য ৫টি হাসপাতাল ও ৭টি ডিসপেনসারির। এদের মধ্যে পার্বতীপুর ও সান্তাহার রেলওয়ে হাসপাতালে তো কোনো চিকিৎসকই নেই। একজন করে ফার্মাসিস্ট দিয়ে চলছে। প্রতিটি ডিসপেনসারিতে দুইজন করে চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও শুধুমাত্র খুলনা ব্যতীত অন্য কোনো ডিসপেনসারিতে কোনো চিকিৎসক নেই। সেখানেও ফার্মাসিস্টরাই চিকিৎসা দেন। পাকশী ও রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতাল ছাড়া কোনো হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সও নেই।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, রেলওয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের চিকিৎসাসেবা, দুর্ঘটনা কবলিত স্থানে দ্রুত গিয়ে আহত রোগীর সেবা প্রদান, বিভিন্ন হাসপাতালে আহত ভর্তিকৃত রোগীদের খোঁজখবর রাখা, এএলএম, এলএম, গার্ড, স্টেশন মাস্টার, পোর্টার, পয়েন্টসম্যানদের নিয়মিত টেস্টসহ স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রেলওয়েতে নব নিয়োগকৃত কর্মচারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, গার্ড-স্টেশন মাস্টারদের নিকট ফাস্ট এইড বাক্স সরবরাহ করা, রেলওয়ে স্টেশন, কলোনী, অফিস ভবন এলাকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা, হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের পথ্য ও খাদ্য সরবরাহ করা এবং দুর্ঘটনা মোকাবেলার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ী প্রস্তুত রাখার জন্য রেলওয়ে হাসপাতাল ও ডিসপেনসারি থেকে সেবা প্রদান করা হয়।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে বহিঃবিভাগসহ ৬টি হাসপাতাল ও ৭টি ডিসপেনসারি রয়েছে। এর মধ্যে সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালে বেডসংখ্যা ৮২টি, পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালে ৪৪টি, লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালে ৩০টি, সান্তাহারে ১৩টি, পার্বতীপুরে ১৬টি এবং রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালে ২০টি বেড রয়েছে। এছাড়া রেলওয়ে ডিসপেনসারী রয়েছে সৈয়দপুর কারখানায়, পার্বতীপুরের কেলোকায়, তিস্তামুখ ঘাটে, বোনারপাড়ায়, ঈশ্বরদী, রাজবাড়ী এবং খুলনায়। এর মধ্যে তিস্তামুখ ঘাট ডিসপেনসারি জনবলের অভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
হাসপাতাল ও ডিসপেনসারি মিলে চিকিৎসকদের মঞ্জুরিকৃত পদ ৩৭টি। অথচ তার বিপরীতে চিকিৎসক আছেন মাত্র ৭ জন। সিনিয়র নার্সদের ৩৩টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৯ জন এবং ফার্মাসিস্ট ৩২ জনের বিপরীতে ১৮ জন কর্মরত আছে। এদের মধ্যে পার্বতীপুর ও সান্তাহার রেলওয়ে হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক নেই। সেখানে ফার্মাসিস্ট দিয়ে হাসপাতাল পরিচালিত হচ্ছে।
যে সাতজন চিকিৎসক আছেন তাদের আবার একাধিক প্রশাসনিক দায়িত্ব দেওয়ায় বেশিরভাগ হাসপাতালে কার্যত ফার্মাসিস্টরাই প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকেন। অনেক ডিসপেনসারিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার মতো ফার্মাসিস্টও নাই।
রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য দায়িত্বে আছেন রেলওয়ে পশ্চিমাঞ্চলের বিভাগীয় চিকিৎসক কর্মকর্তা (সদর) ডা. এস এম মারুফুল আলম। কিন্তু তিনি ছুটিতে থাকায় তার অবর্তমানে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো পাকশী হাসপাতালের বিভাগীয় চিকিৎসক কর্মকর্তা ডা. শাকিল আহম্মদকে।
গত ২৮ ডিসেম্বর রাজশাহী রেলওয়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক আসেন নি। ২০ বেডের হাসপাতালে কোনো রোগীও ভর্তি নাই। হাসপাতালে আধুনিক যন্ত্রপাতি থাকলেও তার কক্ষ তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া যায়। আউটডোরে রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন ফার্মাসিস্ট আব্দুল আজিজ। তিনি জানান, সাধারণত জ্বর, সর্দি, কাশি, ডায়াবেটিস, প্রেশার ও অ্যান্টিবায়োটিকের ওষুধ দেওয়া হয়। গড়ে প্রতিদিন আউটডোরে ১০০ জনের মতো চিকিৎসা নেন বলে জানান তিনি।
এদিকে সৈয়দপুর রেলওয়ে হাসপাতালের বিভাগীয় চিকিৎসক কর্মকর্তা ডা. আনিছুল হককে আবার দুইটি পদের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতালের বিভাগীয় চিকিৎসক কর্মকর্তা এবং পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তারও অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাকে। প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ততার কারণে চাইলেও তিনি চিকিৎসা সেবা দিতে পারেন না।
লালমনিরহাট জেলার বর্তমান ও সাবেক রেলকর্মী, তাদের পরিবারের সদস্য ও রেলপথে যাতায়াতকারীদের চিকিৎসা সেবা দিতে ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় লালমনিরহাট রেলওয়ে হাসপাতাল। এখানে একসময় সিজারিয়ান অপারেশন, শিশুদের কলেরার চিকিৎসা, রক্ত পরীক্ষাসহ বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা সেবা দেয়া হলেও এখন তা বন্ধ। লালমনিরহাটে ৭ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১ জন। নার্স ৭ জনের বিপরীতে ২ জন এবং ফার্মাসিস্ট ৭ জনের বিপরীতে ৩ জন কর্মরত আছে।
লালমনিরহাট বিভাগীয় হাসপাতালের অধীনে রয়েছে পার্বতীপুর রেলওয়ে হাসপাতাল এবং পার্বতীপুরের কেলোকা, তিস্তামুখ ঘাট ও বোনারপাড়ায় রয়েছে ডিসপেনসারি। সবগুলো মিলে মোট ২৩৪টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৯১ জন। পার্বতীপুর রেলওয়ে হাসপাতালে তিনজন চিকিৎসকের পদ থাকলেও সেখানে বর্তমানে একজন চিকিৎসকও কর্মরত নাই। নার্স ৫ জনের জায়গায় কর্মরত আছেন তিনজন এবং ফার্মাসিস্ট দুইজনের জায়গায় কর্মরত আছেন একজন। এই হাসপাতালে কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না। কার্যত ফার্মাসিস্টই চিকিৎসাসেবা প্রদান করে থাকেন।
১৯৬৮ সালে ৩ একর জমির উপর নির্মিত হয় পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় হাসপাতালটি। পাকশী পদ্মা নদীর তীরে মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা এই হাসপাতালটি বর্তমানে চিকিৎসা সেবা তো দূরের কথা, নিজেই বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। বিভাগীয় পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালের অধীনে রয়েছে সান্তাহার রেলওয়ে হাসপাতাল, ঈশ্বরদী, রাজবাড়ী ও খুলনা ডিসপেনসারি।
পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালে ৮৬টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন ৪৫ জন। এর মধ্যে ৫ জন চিকিৎসকের বিপরীতে বর্তমানে ২ জন চিকিৎসক কর্মরত আছেন। নার্স ৮ জনের বিপরীতে ৩ জন এবং ফার্মাসিস্ট ৩ জনের বিপরীতে ২ জন কর্মরত আছেন।
সান্তাহার রেলওয়ে হাসপাতালে ২ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও এখানে কোনো চিকিৎসক নেই। শুধুমাত্র একজন ফার্মাসিস্ট ও এক জন সিস্টার ইনচার্জ রয়েছে। এছাড়া ঈশ্বরদী, রাজবাড়ী ও খুলনা ডিসপেনসারির প্রতিটিতে দুইজন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও খুলনা ডিসপেনসারিতে শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক রয়েছে। বাকি ডিসপেনসারিগুলো ফার্মাসিস্ট দিয়ে চলছে।
পাকশী বিভাগীয় চিকিৎসক কর্মকর্তা ডা. শাকিল আহম্মেদ জানান, হাসপাতালে জনবলের ব্যাপক সংকট। চিকিৎসক না থাকায় সান্তাহারের ইনডোর সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু আউটডোর সেবা দেওয়া হয়। এছাড়া পাকশী রেলওয়ে হাসপাতালে বহির্বিভাগে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ জন চিকিৎসা নিলেও ইনডোরে রোগী ভর্তির হার কম। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে যাদের মাসিক বেতনের বেসিক ১৫ হাজারের বেশি তাদের হাসপাতাল থেকে খাবার সরবরাহ করা হয় না। মাসিক বেতন বেসিক ১৫ হাজারের কম হলে হাসপাতাল থেকে খাবার সরবরাহ করা হয়। এজন্য অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন না। এছাড়া হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকায়ও রোগী ভর্তি হন না। শুধু আউটডোর থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।
তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে ২০ বছর ধরে অস্ত্রোপচারের কক্ষ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া এক্সরে অ্যাটেনডেন্ট নাই, ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট নাই। বছরখানেক এক্স-রে মেশিন বন্ধ ছিল। ফিল্ম কেনায় এখন এক্সরে ও ইসিজি করা হয় হাসপাতালে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার অসীম কুমার তালুকদার জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে প্রচুর জনবল ঘাটতি আছে। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের ২১ হাজার ৭০০ টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ৯,৮০০ জন। ১১,৯০০টি পদ শূন্য রয়েছে। এর মধ্যে নতুনভাবে ২০০০ জনবল রিক্রুটমেন্টের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শূন্যপদগুলোতেও নিয়োগ দেওয়া হবে।
তিনি জানান, পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়েতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাদের পরিবারের সদস্যরা, যাত্রীদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮৪,৪৮,৪৯৪ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৫,০২,৭৬৭ টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯৮,০৪,৫০২ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিলো। ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য এখনো কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।