গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহে লাগবে নিবন্ধন, চাপ বাড়বে নগরবাসীর
- আবেদন করতে লাগবে ৫ হাজার টাকা
- জামানত দিতে হবে ১০ লাখ টাকা, বার্ষিক ফি ১০ লাখ
- একটি প্রতিষ্ঠান একটিমাত্র ওয়ার্ডের জন্যই আবেদন করতে পারবেন
- বাসাবাড়ি থেকে সর্বোচ্চ ফি ১০০ টাকা নিতে পারবে সংগ্রহকারীরা
- ঢাকার দুই সিটিতে বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ময়লা-বাণিজ্য
২০২০ সাল থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেয় দরপত্রের মাধ্যমে তবে এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরেনি বরং বেড়েছে বিশৃঙ্খলা; পাশাপাশি বাড়তি ফি দিতে হচ্ছে নগরবাসীর। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনও তাদের এলাকার বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহে বার্ষিক চুক্তির ভিত্তিতে তৃতীয় পক্ষকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে সেটা টেন্ডারের মাধ্যমে নয়, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবেদনের ভিত্তিতে।
গত ৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, উত্তর সিটির ওয়ার্ডগুলো থেকে গৃহস্থালি বর্জ্য সংগ্রহের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান (ভ্যানসার্ভিস) নিবন্ধনের আবেদনপত্রের মূল কপি ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ অফিস চলাকালীন সময়ে উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার দপ্তর থেকে ৫ হাজার টাকার পে-অর্ডারের বিনিময়ে সংগ্রহ করা যাবে। অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো বাসা-বাড়ি থেকে ফি বাবদ টাকা আদায় করবে। যদিও এখনই সিটি করপোরেশন পরিচ্ছন্নতাবাবদ হোল্ডিং থেকে ৩ শতাংশ হারে ট্যাক্স আদায় করছে।
নতুন এ ব্যবস্থাপনাতে নগরবাসী আরও বেশি ভোগান্তি ও খরচের মধ্যে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বিশেষজ্ঞরা।
নগর পরিকল্পনাবিদ এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান টিবিএসকে বলেন, রাজশাহী-খুলনাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিটি কর্পোরেশনই করে কিন্তু ঢাকাতে কর নিলেও সেই সেবা দিচ্ছে না কর্পোরেশন। এখন যদি উল্টো এটাকে ব্যবসায় পরিণত করে তবে একদিকে সাধারণ মানুষের খরচ বাড়বে এবং এ বর্জ্য নিয়ে বাণিজ্যকে আরও প্রমোট করা হবে। সিটি কর্পোরেশনের এ ধরনের সিস্টেম কাউন্সিলর এবং ক্ষমতাসীন নেতাদের বলয়ের সুরক্ষা দিতে তৈরী করেছে। শৃঙ্খলা আনা ব্যতীত এ ধরনের ব্যবস্থা দিয়ে সমাধান হবে না।
তিনি আরও বলেন, সিটি করপোরেশন যদি জনবল বাড়িয়ে নিজেরা এই দায়িত্ব পালন করত, তাহলে জনগণের জন্য এই দিকটা আরো সাশ্রয়ী হতো। আর সিটি করপোরেশনেরও রাজস্ব আদায় হতো। কিন্তু এখন মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান আবেদনের পরে নিবন্ধন পেলে জামানত হিসেবে ১০ লাখ টাকা এবং প্রতি বছর ১০ লাখ টাকা ফি দিতে হবে। তবে উত্তর সিটির নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের ক্ষেত্রে ৫ লাখ টাকা জামানত এবং ৫ লাখ টাকা বার্ষিক ফি দিতে হবে।
জানা যায়, উত্তর সিটির বর্জ্য সংগ্রহের আবেদনের ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতা, ব্যাংক সলভেন্সি (ব্যাংক সচ্ছলতা), পর্যাপ্ত গাড়ি ও নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোর।
এক এলাকা থেকে অনেকগুলো আবেদন এলেও একটি সিলেকশন কমিটির মাধ্যমে এর অনুমোদন দেওয়া হবে। আর প্রতি ওয়ার্ডে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা-আবর্জনা নেওয়ার ফি ১০০ টাকা এবং নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে ধরা হয়েছে ৫০ টাকা।
তবে বিভিন্ন ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ফি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও ২০-২৫ লাখ টাকা ব্যয় করে এবং অন্য সব শর্ত মেনে ১০০ টাকা ফি তে খরচ মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বাধ্য হয়েই এ ফি ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা নিতে হবে।
দক্ষিণ সিটি বাসা থেকে ময়লা সংগ্রহে মাসে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা ও দোকানপাট থেকে সংগ্রহে ৩০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছিল। দক্ষিণ সিটি টেন্ডারের মধ্যে নিয়ে আসার পরে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ময়লা সংগ্রহ নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। অধিকাংশ ওয়ার্ডেই নির্ধারিত ফি এর থেকে বেশি টাকা নেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাসাবাড়ি থেকে মাসে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।
যদিও সিটি করপোরেশন হোল্ডিং ট্যাক্সের (গৃহকর) সঙ্গে ৩ শতাংশ ময়লা-আবর্জনার জন্য কর নিয়ে থাকে।
সিটি করপোরেশন আইন অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব হচ্ছে বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থান থেকে সংগ্রহ করে ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে ফেলবে। এজন্য করপোরেশন নগরীর বিভিন্ন স্থানে ময়লা ফেলার পাত্র বা অন্য কোনো আধারের ব্যবস্থা করবে। আর নাগরিকেরা তাদের বাসাবাড়ির বর্জ্য করপোরেশনের নির্ধারিত বিনে পৌঁছে দেবে।
প্রতি অর্থবছরে বাসিন্দাদের কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন প্রায় ২০০ কোটি পরিচ্ছন্নতা কর আদায় করেছে। অথচ তারা বাসাবাড়ি থেকে সরাসরি বর্জ্য সংগ্রহ না করে উল্টো আবারও খরচের চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
কিন্তু সিটি কর্পোরেশনের যে নির্ধারিত স্থান রয়েছে সেখানে কারো পক্ষেই সম্ভব নয় বাসাবাড়ির বর্জ্য পৌঁছে দেয়া। এই সুযোগে বহু বছর ধরে বিভিন্ন ওয়ার্ডভিত্তিক সংগঠন বাসাবাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে করপোরেশনের নির্ধারিত বিনে পৌঁছে দিচ্ছে। এজন্য প্রতিটি বাসা বা হোল্ডিং থেকে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সংগ্রহকারী সংগঠনগুলোর সভাপতি নাহিদ আকতার লাকি টিবিএসকে বলেন, যারা বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহ করে তারা অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে যারা অনেকদিন থেকে কাজ করে আসছে তাদেরকে স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এখন আবার যে নিবন্ধনের দিকে যাচ্ছে এতে আমরা আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমাদেরকে বাধ্য হয়েই ১০০ টাকার ফি ২০০ টাকা করতে হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এ ধরনের পদ্ধতিতে যাওয়ার পরে সেখানে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আগের থেকে আরও বেশি খারাপ হয়েছে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপপ্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মফিজুর রহমান ভূঁইয়া টিবিএসকে বলেন, আমরা বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলায় আনতেই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। সিটি কর্পোরেশনের নিয়মকানুন না মানলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া অতিরিক্ত ফি এর বিষয়ে অভিযোগ করলে আমরা ব্যবস্থা নিবো।
ঢাকায় বাসাবাড়ির বর্জ্যে ৫০০ কোটি টাকার বাণিজ্য
ঢাকার দুই সিটিতে মোট ওয়ার্ড ১২৯টি। এগুলোর মধ্যে ৯৩টি ওয়ার্ড আগে ছিল। ৩৬টি ওয়ার্ড নতুন। রাজধানীর বাসাবাড়ি, রেস্তোরাঁ থেকে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কী পরিমাণ টাকা আদায় করে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। তবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, নগরবাসী ও বর্জ্য সংগ্রহকারীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে ২৬৯২২৯টি এবং দক্ষিণ সিটিতে ২৫৮৫৩৩টি হোল্ডিংসহ দুই সিটি কর্পোরেশনে প্রায় ৫২৭৭৬২টি হোল্ডিং রয়েছে। আর প্রতিটি হোল্ডিংয়ের বিপরীতে ১টি থেকে ১০০টিরও অধিক ফ্ল্যাট বা বাসা রয়েছে। একটি হোল্ডিংয়ে গড়ে ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকে গড়ে প্রতি মাসে ১৫০ টাকা করে আদায় করা হয়। এই হিসাবে বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে প্রায় ৪০ কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে, যা বছরে প্রায় ৪৭৪ কোটি টাকা।
এছাড়া বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাবে, রাজধানীতে প্রায় ১৫ হাজার রেস্তোরাঁ রয়েছে। প্রতিটি রেস্তোরাঁ থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে ১ থেকে ১০ হাজার টাকা নেওয়া হচ্ছে। গড়ে ১৫০০ টাকা হিসেবে রেস্তোরাঁ থেকে মাসে আদায় হচ্ছে ২.২৫ কোটি টাকা, যা বছরে ২৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান টিবিএসকে বলেন, আমাদের প্রতিটি রেস্টুরেন্ট থেকে বর্জ্য সংগ্রহের জন্য এক হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। সিটি করপোরেশন ট্যাক্সও নিচ্ছে আবার বর্জ্যের জন্য টাকাও দিতে হচ্ছে। আর এ টাকার পরিমাণ কিছুদিন পরপরই বাড়ানো হয়।