সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে আশুগঞ্জ নদীবন্দর
বিদ্যুৎকেন্দ্র ও সারকারখানার জন্য সারাদেশে সুপরিচিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ উপজেলা। প্রতিদিন আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে প্রায় ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আর দেশের অন্যতম ইউরিয়া সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান আশুগঞ্জ সারকারখানা থেকে সার যাচ্ছে আওতাভুক্ত সাত জেলায়। বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্যের কারণে আশুগঞ্জ এখন হয়ে উঠেছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক শহর।
মেঘনা নদীর তীরের এই শহর এখন পুরো জেলার অর্থনীতির 'লাইফলাইন' হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত নদীবন্দরের কারণেই ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব ব্যবসায় প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে ৫০ কোটি টাকারও বেশি, আর এ বন্দর ঘিরে বছরজুড়ে লেনদেন হয় ১৮ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। পাশাপাশি কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত ১৫ হাজার মানুষের।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৬৭ দশমিক ৫৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনের আশুগঞ্জ উপজেলাটি চট্টগ্রাম বিভাগের সবচেয়ে ছোট উপজেলা। এই উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া মেঘনা নদী ঘিরে গড়ে ওঠা নৌবন্দর পাল্টে দিয়েছে অর্থনীতি ও এখানকার মানুষের জীবনমান।
জনশ্রুতি আছে, ১৮৯৮ সালে আশুগঞ্জের গোড়াপত্তন হয়। মেঘনার তীরে পাট এবং আউশ ধান বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে গঞ্জ গড়ে উঠে। সেই থেকেই নামকরণ হয় আশুগঞ্জ। আর এই মেঘনা নদীকে ঘিরে যেসব ব্যবসাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে ধান ও চাল অন্যতম। এ দুই ব্যবসায় প্রতিদিন লেনদেন হচ্ছে ১৫ কোটি টাকারও বেশি।
মেঘনার ভিওসি ঘাটে শতবছরেরও বেশি সময় ধরে ধানের বাজার বসছে। ধানের এই বাজারকে দেশের পূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড় মোকাম ধরা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাড়াও আশেপাশের অন্তত ৭ জেলার কৃষকের ধান মোকামে নিয়ে আসেন বেপারীরা।
প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটতেই ধানের ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখর হয়ে উঠে ভিওসি ঘাট। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে ধান কেনাবেচা। মোকামটিতে বিভিন্ন জাতের ধান পাওয়া যায়। যার মধ্যে অন্যতম বিআর-২৮, বিআর-২৯, বিআর-৪৯ ও বিআর-২২। দৈনিক ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার ধান বেচাকেনা হয় আশুগঞ্জ মোকামে।
এছাড়া ধানের মোকাম ঘিরে আশুগঞ্জে সারাবছরই জমজমাট থাকে চালের ব্যবসা। জেলায় চালকল আছে প্রায় দুইশ। যার অর্ধেকেরও বেশি আশুগঞ্জে। এসব চালকল থেকে প্রতিদিন ১০ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের চাল বাজারজাত হয় দেশের বিভিন্ন স্থানে। আর চালকলগুলোতে কর্মসংস্থান হয়েছে ১০ থেকে ১২ হাজার মানুষের।
আশুগঞ্জ উপজেলা চালকল মালিক সমিতির সদস্য হাসান ইমরান বলেন, 'ধানের মোকাম ঘিরে আমাদের চালের ব্যবসাও ভালো চলে। প্রতিদিন অন্তত ১০ কোটি টাকার চাল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হয়। সরকারের সহযোগিতা এবং ব্যাংকগুলো যদি সহজ শর্তে ঋণ দেয়, তাহলে ধানচালের ব্যবসা আরও প্রসারিত হবে। পাশাপাশি আরও বহু মানুষের কর্মের সংস্থান করা যাবে'।
এদিকে নদীবন্দর ঘিরে আশুগঞ্জ ফেরিঘাটে চাঙা হয়ে উঠেছে সার, রড ও সিমেন্টসহ বিভিন্ন নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা। এসব ব্যবসায়ও প্রতিদিন বড় অংকের লেনদেন হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এসে ভিড়ে আশুগঞ্জ নদীবন্দরে। জাহাজ থেকে ট্রাকে পণ্য লোড এবং আনলোড কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ১ হাজার শ্রমিকের। একেকজন শ্রমিক দিনে আয় করেন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মূলত সড়ক, নৌ ও রেলপথ সংযুক্ত হওয়ায় বাণিজ্য বসতি গড়ে উঠেছে আশুগঞ্জে। ব্যবসায়ীরা নৌবন্দর ব্যবহার করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসার জন্য পণ্য আনতে পারছেন। এছাড়া বন্দরে আসা বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য সড়ক ও নৌপথে সহজে পাঠানো যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে। এসব পণ্য পরিবহনে গড়ে উঠেছে পরিবহন ভাড়ার ব্যবসাও। প্রতিদিন কয়েকশ ট্রাক বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে ছুটে যায় বিভিন্ন গন্তব্যে।
তবে যে নদীবন্দর গতিশীল করেছে পুরো জেলার অর্থনীতিকে, সেখানে লাগেনি উন্নয়নের ছোঁয়া। অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পর আন্তঃদেশীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে ২০০৮ সালে আশুগঞ্জ নৌবন্দরকে 'পোর্ট অব কল' ঘোষণা করা হয়। এরপর ২০১১ সালে প্রথমবারের মতো এ নৌবন্দর ব্যবহার করে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পরিবহন করা হয় ভারতের ত্রিপুরার পালাটানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল। পরবর্তীতে ভারত ও বাংলাদেশের নৌ-প্রটোকল চুক্তির আওতায় আরও কয়েক ধাপে আশুগঞ্জ নদীবন্দর ও আখাউড়া স্থলবন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হয়েছে।
তবে নদীবন্দরে মাত্র দুটি জেটি থাকায় জাহাজ থেকে পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়। এছাড়া বন্দরের একমাত্র ওয়্যারহাউজটি নির্মিত হয়েছিল ভারতীয় পণ্য রাখার জন্য। ফলে এটিও ব্যবহার করতে পারছেন না স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি নেই কোনো ট্রাক ইয়ার্ড।
আশুগঞ্জ শহর শিল্প ও বণিক সমিতির সভাপতি গোলাম হোসেন বলেন, 'ভৌগলিক অবস্থান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হওয়ায় আশুগঞ্জ এখন পুরো জেলার ব্যবসা কেন্দ্র। প্রতিদিন এখানে বিভিন্ন ব্যবসায় লেনদেন হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টাকা। বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। সবকিছুই হয়েছে নৌবন্দরের কারণে। তাই নৌবন্দরটির যদি অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা যায়, তাহলে বাণিজ্য বেড়ে দ্বিগুণ হবে।'
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজার নদীবন্দরের উপ-পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, 'আশুগঞ্জে একটি কন্টেইনার টার্মিনাল পোর্ট করা হচ্ছে। এ পোর্ট থেকে সরাসরি মোংলা এবং চট্টগ্রাম থেকে অভ্যন্তরীণ পথে কন্টেইনারগুলো আশুগঞ্জে আসবে। এখানে জেটি যেমন থাকবে, তেমনি স্বয়ংক্রিয়ভাবে পণ্য ওঠানামার সুবিধাও থাকবে।'
'এছাড়া আমরা এখানে আধুনিক কার্গো জেটি করছি। যেখানে পণ্য ওঠানামার পাশাপাশি সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা থাকবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এ কাজগুলো শুরু হবে', বলেন রেজাউল করিম।