ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ ই-টিকেটিং
একটি বেসরকারি কোম্পানির কর্মী সালমান হোসেনকে শিকড় পরিবহনের বাসে রাজধানীর ফার্মগেট থেকে মৎস ভবন মোড়ে যেতে ভাড়া দিতে হয়েছে ১৫ টাকা এবং তাকে টিকিট দেওয়া হয়েছিল ফার্মগেট থেকে গুলিস্তানের। বিষয়টি নিয়ে তিনি যখন প্রতিবাদ জানান, তখন বাসের সুপারভাইজার তাকে বলেন, শাহবাগের পর গুলিস্তানের আগে কোনো স্টপেজ নেই। তাই কেউ যদি ই-টিকিট কেনে, তাহলে তাকে গুলিস্তানের ভাড়াই দিতে হবে। সেই সাথে তারা যাত্রাপথে ওয়েবিল চেকের (যাত্রীর তালিকা) দোহাইও দেয়।
এ প্রসঙ্গে সালমান হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ই-টিকেটিং চালু হওয়ার পর কয়েকদিন খুব ভালোভাবেই কাজ করছিল। কিন্তু এখন এটা আবার আগের অবস্থায় ফিরে গিয়েছে। ফার্মগেট থেকে মৎস্য ভবন মোড় পর্যন্ত ৩.৫ কিলোমিটার রাস্তার ভাড়া সর্বোচ্চ ১০ টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু বাসচালক-কন্ডাক্টররা তাদের ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করে থাকেন।
তাছাড়া ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী অধিকাংশ বাসই টিকিট দেয় না। সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, টিকিট না দিয়েই মতিঝিল থেকে বাংলামোটর যাওয়ার জন্য শাহানা বেগম নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৫ টাকা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। তিনি টিবিএসকে বলেন, "ভাড়া ১০ টাকা হওয়া সত্ত্বেও বাসের সুপারভাইজার আমার কাছ থেকে ১৫ টাকা ভাড়া নিয়েছে। এদিকে আমি টিকিট চাওয়ার পর কন্ডাক্টর আমাকে বলে যে পিওএস মেশিনে সমস্যা হয়েছে।"
সালমান হোসেন বা শাহানা বেগমের মতো আরও অনেক যাত্রীই ঢাকা শহরে যাতায়াতের ক্ষেত্রে এরকম ভোগান্তির শিকার হয়ে চলেছেন।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকার গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা নিয়ে আসার জন্য ই-টিকেটিং সিস্টেম চালু করা হয়। পরবর্তীতে কয়েক ধাপে ঢাকার অধিকাংশ বাসে এই সিস্টেম চালু করা হয়।
যাত্রীদের প্রত্যাশা ছিল, ই-টিকেটিং চালু হওয়ার পর ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিনের যে বিশৃঙ্খলা ছিল তা মিটে যাবে এবং বাসে ওঠার পরে আর এই সমস্যা নিয়ে তর্ক করার প্রয়োজন হবে না। কিন্তু যাত্রীদের হতাশ করে কিছুদিন পর সেই আগের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিই ফিরে এসেছে।
বেশিরভাগ বাস কোম্পানিই ওয়েবিল সিস্টেম চালু করেছে; কিন্তু যাত্রীদের অভিযোগ- এর মাধ্যমে ই-টিকিটের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সেই সাথে, একই রুটে চলাচলকারী বিভিন্ন কোম্পানির বাসের স্টপেজ ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায় ই-টিকেটের ভাড়ায়ও পার্থক্য রয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, বাসচালকের সহকারীরা এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে কাজ করার কথা থাকলেও; যাত্রীরা বারবার টিকেট চাওয়া সত্ত্বেও তারা টিকেট দিতে আগ্রহ দেখান না। তার উপর যেসব যাত্রীর কাছ থেকে অন্যায্য ভাড়া আদায় করা হয়, তারা চাইলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ দাখিল করতে পারেন না; কারণ টিকিটের গায়ে লেখা নম্বরগুলো বন্ধ দেখায়।
গত কয়েকদিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গণপরিবহনগুলোতে ঘুরে দেখা গেছে- মতিঝিল, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, মিরপুর, গাবতলিসহ বিভিন্ন রুটের বাসের বেশিরভাগ কন্ডাক্টর বা তাদের সহকারীরা ই-টিকিটের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করছেন।
অতিরিক্ত ভাড়া আদায় নিয়ে বাস কন্ডাক্টরের সাথে যাত্রীদের তর্ক-বিতর্কও খুবই পরিচিত একটি দৃশ্য। এর পাশাপাশি, যাত্রীরা ভিন্ন কোনো স্টপেজ থেকে উঠলেও, তাদেরকে টিকিট ধরিয়ে দেওয়া হয় নির্দিষ্ট একটি স্টপেজের নাম উল্লেখ করে। এর ফলে দুই পক্ষে তুমুল ঝগড়া-বিবাদের সৃষ্টি হয়।
প্রথম ধাপে, গত বছরের নভেম্বরে মিরপুর রুটের ৩০টি বাস কোম্পানিকে ই-টিকেটিং এর আওতায় নিয়ে আসা হয়। এরপরে দ্বিতীয় ধাপে চলতি বছরের জানুয়ারিতে আরও ১৫টি কোম্পানিকে এই সিস্টেমের আওতায় আনা হয়।
ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ৬০টি কোম্পানির প্রায় ৩৫০০ বাস ঢাকার ৯৬টি রুটে চলাচল করে। এর বাইরে, ঢাকার আশেপাশের শহরগুলো থেকে আরও ৪০টি কোম্পানির প্রায় ২৫০০ বাস ঢাকায় যাত্রী আনা-নেওয়া করে। বর্তমানে ১০০টি কোম্পানির প্রায় ৬০০০ বাস ঢাকা শহরে গণপরিবহণ হিসেবে চলাচল করছে।
যাত্রাবাড়ি-মিরপুর রুটে চলাচলকারী শিকড় পরিবহনের একজন সহকারী, রবিউল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, বাসেই ই-টিকিট নেওয়ার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু যাত্রীর চাপে সবাইকে টিকিট দেওয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া, সব স্টপেজ অনুযায়ী ভাড়ার অঙ্কও পিওএস মেশিনে উল্লেখ নেই। তাই কখনো কখনো যাত্রী কিছু ভাড়া বেশি দিতে হয়।
"বাস মালিকেরা ওয়েবিল পদ্ধতির মাধ্যমে বাস থেকে টাকা সংগ্রহ করে। তাই আমরা টিকিট দিচ্ছি নাকি দিচ্ছি না, তাতে কিছু যায় আসে না। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মামলা এড়াতে আমরা টিকিট দেওয়ার মাধ্যমে ন্যায্য ভাড়াই আদায় করি", বলেন রবিউল।
যাত্রীদের টিকিট না দেওয়া প্রসঙ্গে আয়াত পরিবহনের সহকারী জামাল টিবিএসকে বলেন, কখনো কখনো যাত্রীদের কাছে টাকা কম থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা টিকিট দেই না। কিন্তু টিকিটের গায়ে তো নাম্বার আছেই, সেখানে কল করে যাত্রীরা তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন।
এদিকে, ই-টিকেটিং এর বিষয়ে টিবিএসের সঙ্গে কথা বলার সময় আয়াত, বিহঙ্গ, বিকল্প অটো সার্ভিস, মিরপুর লিংক, শিকড়, খাজা বাবা, আলিফ পরিবহন, বাহন, গাবতলী এক্সপ্রেস, মনজিল পরিবহন ও ট্রান্স সিলভা লিমিটেডের মতো কোম্পানিগুলোর বাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন সাধারণ যাত্রীরা।
তবে বাস অ্যাটেন্ডেন্টদের দাবি, সিটিং সার্ভিস বাসগুলোতে বসে থাকার তুলনায় দাঁড়িয়েই বেশি যাত্রী যায়, ফলে তাদের সবাইকে টিকিট দেওয়া সম্ভব হয় না। যেহেতু নগরীর রাস্তায় মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় গণপরিবহনের সংখ্যা কম, তাই প্রতিটি বাসই তাদের ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করে।
বেশকিছু বাসে দেখা গেছে, যাত্রীরা তর্ক করলে তাদের কয়েকজনকে টিকিট দেওয়া হয়। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পিওএস মেশিনে কাগজ ফুরিয়ে গেছে কিংবা মেশিন ফিলিং স্টেশনে রয়েছে- ইত্যাদি অজুহাত দিয়ে টিকিট দেওয়া হয় না। যাত্রীরা আরও অভিযোগ করেন যে রাতের বেলা বাসে চড়লে ই-টিকিট দেওয়া হয় না।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ টিবিএসকে বলেন, "ই-টিকেটিং পদ্ধতি বাস্তবায়নে বেশকিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এ সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য ইতোমধ্যেই নয়টি বিশেষ টিম কাজ করছে।"
তিনি জানান, চলতি মাসের (ফেব্রুয়ারি) ২৮ তারিখের মধ্যেই রাজধানীর সব বাস ই-টিকেটিং এর আওতায় নিয়ে আসা হবে।
"আমরা ইতোমধ্যেই বিআরটিএ'র সাথে কথা বলেছি টিকিটে যাত্রাপথের দূরত্ব সঠিকভাবে উল্লেখের বিষয়ে। আশা করছি, এ বিষয়ে আমরা একটা সমাধানে আসতে পারব", বলেন তিনি।
বাসগুলোতে এখনো আগের মতো কিছু অনিয়ম ও ওয়েবিল সিস্টেম রয়ে গেছে স্বীকার করে এনায়েত উল্লাহ আরও বলেন, "আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। একটা সিস্টেমের উন্নয়নসাধনে কিছুটা সময় লাগে। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই এই সমস্যাগুলোর সমাধান হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী টিবিএসকে বলেন, "গণপরিবহনে নগদ লেনদেন বন্ধ না হলে ভাড়ার নৈরাজ্য কমবে না। শুধু ই-টিকেটিং চালু করেই সড়কে শৃঙ্খলা আনা সম্ভব নয়। চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য ঠেকানো না গেলে শুধু এই সিস্টেমের মাধ্যমে গণপরিবহনে বিশৃঙ্খল অবস্থা পরিবর্তন করা যাবে না।"
তিনি আরও বলেন, "ই-টিকেটিং-এর ফলে কিছু জায়গায় ভাড়া বেড়েছে, আবার কিছু জায়গায় কমেছে। আমাদের যাত্রীদের আইনি সুরক্ষা দরকার। আমরা হতাশ কারণ ই-টিকেটিং আমাদের প্রত্যাশা পূরণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।"
এছাড়াও, দেশের পরিবহন খাতে আমূল পরিবর্তন দরকার এবং এটি ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।