ডিজিটালাইজেশনের দিকে এগোচ্ছে দেশের বীমা শিল্প
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি অর্থের অপব্যবহার এবং পলিসি হোল্ডারদের হয়রানি কমাতে দেশের বীমা খাতে ডিজিটালাইজেশনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
বেশকিছু বেসরকারি বীমা কোম্পানি এখন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে পরিষেবা দিতে শুরু করেছে; অনেকেই আবার বিনিয়োগ করছে অটোমেশনে।
নতুন এই ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষও (আইডিআরএ) চাইছে সমস্ত প্রাইভেট কোম্পানিকে অটোমেশন বা ইন্সুরটেক প্রযুক্তির মাধ্যমে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসতে।
নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ বলছে, অটোমেশনের মাধ্যমে বীমা কোম্পানিগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মের অধীনে আনতে পারলে গ্রাহক হয়রানি কমবে অনেকাংশে; কারণ এই প্রক্রিয়া চালু হলে বীমার টাকা প্রাপ্তি এবং দাবি নিষ্পত্তি সম্পূর্ণটাই ডিজিটালভাবে সম্পন্ন হবে।
সোমবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে আইডিআরএ'র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, কিছু কোম্পানির অনিয়মের কারণে গ্রাহকরা এই খাতের প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন।
নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি বীমাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোরও বিশ্বাস, বীমা শিল্প ডিজিটালাইজড হলে এই খাতে আস্থা বাড়বে গ্রাহকদের। বীমা কোম্পানিগুলোর ফিল্ড এজেন্টদের মাধ্যমে পলিসি সংগ্রহ বন্ধ হবে এবং গ্রাহকরা অনলাইন বা মোবাইল আর্থিক পরিষেবার মাধ্যমে ঘরে বসেই সফ্টওয়্যার দিয়ে প্রিমিয়াম জমা দিতে পারবেন।
এর ফলে গ্রাহক হয়রানি, প্রিমিয়াম পরিশোধ না করার প্রবণতা, অর্থের অপব্যবহার, বীমা দাবি পরিশোধ না করাসহ নানান ধরনের জটিলতার অবসান ঘটবে।
আইডিআরএ প্রধান বলেন, "এজেন্টরা আচরণবিধি (কোড অফ কন্ডাক্ট) জানে না। এখন যেহেতু তরুণ প্রজন্ম এজেন্টদের ওপর ভরসা করছে না, তাই কোম্পানিগুলোকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেই মার্কেটিং করতে হবে।"
ডিজিটাইজেশন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরেই সংস্থাটি ই-রসিদ বাধ্যতামূলক করেছে।
২০১৯ সালে ইউনিফাইড মেসেজিং প্ল্যাটফর্ম (ইউএমপি) চালু করে পলিসিধারী বা বীমাগ্রহীতাদের মোবাইল ফোনে প্রিমিয়াম পেমেন্ট সংক্রান্ত তথ্য পাঠাতে শুরু করে আইডিআরএ। এখন বীমা কোম্পানির সঙ্গে গ্রাহকদের প্রতিটি লেনদেন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথেই মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়, এভাবেই নিশ্চিত করা হচ্ছে স্বচ্ছতা।
প্ল্যাটফর্মটি অ্যাপের মাধ্যমে গত তিন বছর ধরে বীমা গ্রহীতাদের ই-রসিদ সরবরাহ করছে। এই ই-কেওয়াইসি পদ্ধতি গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর পাশাপাশি কুরিয়ার ও মুদ্রণ খরচও বাঁচাচ্ছে অনেকাংশে।
২০২১ সালে জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রত্যেক বীমা কোম্পানিকে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাবেসের সাথে সমন্বিত অ্যাকাউন্টিং সফ্টওয়্যার এবং পলিসি ম্যানেজমেন্ট সফ্টওয়্যার সমন্বয় করে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কম্পিউটারাইজড সিস্টেম নিশ্চিত করতে হয়।
আইডিআরএর তথ্য অনুযায়ী, এর মাধ্যমে ২০২২ সালে মোট বীমা প্রিমিয়াম ১২.০৪ শতাংশ বেড়েছে।
কর্তৃপক্ষের মতে, প্রত্যেক বীমাকারী প্রতিষ্ঠান এখন কাস্টমাইজড সফ্টওয়্যার তৈরি করে আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্রাহকদের সেবা প্রদান করছে।
এরকমই একটি বীমা প্রতিষ্ঠান গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্স। ২০১৯ সাল থেকে কোম্পানিটি গ্রাহকদেরকে ডিজিটাল অ্যাপের মাধ্যমে সেবা দিয়ে আসছে।
গার্ডিয়ান লাইফ ইন্স্যুরেন্সের অ্যাসিস্টেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট (মার্কেটিং অ্যান্ড কমিউনিকেশনস ডিপার্টমেন্ট) নওরীন ইসলাম বলেন, "সবার আগে গার্ডিয়ান লাইফই 'মাইগার্ডিয়ান' নামে অ্যাপ চালু করে; এই অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকরা বাড়িতে বসেই বীমার সব কাজ সম্পন্ন করতে পারেন।"
প্রথম সাধারণ বীমা কোম্পানি হিসেবে ২০১৮ সালে অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম চালু করে গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। ২০২০ সালে, কোম্পানিটি 'ইন্সুমামা' নামে একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করে। এই অ্যাপের মাধ্যমে বীমা পলিসি ক্রয় হয়ে ওঠে আরও সহজ এবং দ্রুত।
এছাড়া, গ্রীন ডেল্টা ডিজিটালাইজেশনের পরিধি আরও বাড়াতে এবং শক্তিশালী আইটি অবকাঠামো তৈরিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অতিপরিচিত বীমা প্রতিষ্ঠান মেটলাইফ, বাংলাদেশে বীমা সেবা ডিজিটাইজেশনের ক্ষেত্রে অগ্রদূত। অনলাইন দাবি নিষ্পত্তি, স্মার্ট কাস্টমার পোর্টাল, ডিজিটাল প্রিমিয়াম পেমেন্ট চ্যানেল, ৩৬০ হেলথ মোবাইল অ্যাপ, হ্যালো বীমা হটলাইন এবং হ্যালো বীমা কমিকস- সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চালু হওয়া মেটলাইফের উদ্ভাবনী ডিজিটাল সেবাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
মেটলাইফ বাংলাদেশের সিইও আলা আহমদ টিবিএসকে বলেন, "এই খাতের জন্য ডিজিটালাইজেশন অপরিহার্য; কারণ এর মাধ্যমে বীমা পরিষেবা বিস্তৃত পরিসরে মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে এবং গ্রাহকদের কাছে এটি হয়ে ওঠে আরও সুবিধাজনক ও জনপ্রিয়।"
ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় দাবি নিষ্পত্তি কীভাবে বীমা গ্রাহকদের উপকারে আসে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, "এখন প্রতি তিনজনের মধ্যে দুইজন গ্রাহক এই ডিজিটাল দাবি নিষ্পত্তির টুল ব্যবহার করছেন। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে আমরা এখন ৩ থেকে ৫ দিনের মধ্যেই দাবি নিষ্পত্তি করতে পারছি।"
আইডিআরএ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জয়নুল বারী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "বীমা কোম্পানিগুলো ধীরে ধীরে ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আসছে। আমরা প্রতিনিয়ত কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে বলছি। বীমা কোম্পানি তাদের নিজস্ব সফটওয়্যার ব্যবহার করছে। গ্রাহকরা এখন সহজেই দেখতে পারছেন তাদের প্রিমিয়াম জমা হচ্ছে কিনা। তারা মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে প্রিমিয়াম জমা দিতে পারছেন। আমরা সব বীমা কোম্পানিকে এই অটমেশনের আওতায় আনতে চাই।"
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের বীমা খাতে উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন চলছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বীমা কর্পোরেশনগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও দেশে বীমার পরিধি বাড়ানো।
আইডিআরএর চেয়ারম্যান জানান, প্রকল্পের কাজ শেষ হলে বেসরকারি কোম্পানিগুলো তা পরীক্ষা করে দেখবে। বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলো এখন তাদের নিজস্ব অফিস থেকে ডিজিটালাইজেশনের কাজ করে যাচ্ছে।
"যখন সম্পূর্ণ অটোমেশন এবং ইন্সুরটেক প্রযুক্তি চালু করা হবে, তখন আমরা বীমা কোম্পানির সঙ্গে সংযুক্ত হব। আমরা তখন সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করতে পারবো," যোগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন টিবিএসকে বলেন, "বীমা খাতের ডিজিটালাইজেশন এখন উন্নত হয়েছে। গ্রাহকরা এখন বীমা খোলা থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত, সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। পুরো বীমা খাত এখন অটোমেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে; ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি আরও বিস্তৃত হবে।"
২০২২ সালে জাতীয় বীমা দিবসের অনুষ্ঠানে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বীমা ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশন এবং স্বয়ংক্রিয়করণের পাশাপাশি এই খাতকে নতুন প্রযুক্তির আওতায় আনার ওপর জোর দিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা এখন ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে।