নীলফামারীতে মানববর্জ্য থেকে তৈরি সার ব্যবহৃত হচ্ছে কৃষিজমিতে
মানববর্জ্য কাজে লাগিয়ে তা থেকে অর্গানিক জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে নীলফামারীর সৈয়দপুর ফিকাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে। দেশের কৃষিতে ক্রমবর্ধমান সারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি ভালো সমাধান দিতে চালু করা হয়েছে এই ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট।
মানববর্জ্য থেকে তৈরি জৈব সার কৃষি জমিতে ব্যবহারের পাশাপাশি, সার বিক্রি করে রাজস্বও আয় করছে সৈয়দপুর পৌরসভা।
সৈয়দপুরের ফিকাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট মডেল দেশের অন্য সব পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে অনুসরণ করা হলে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সংকট কাটবে এবং সেইসঙ্গে পরিবেশও পরিচ্ছন্ন থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সমন্বিত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে ওয়াটার এইড বাংলাদেশের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ২০১৮ সালে ফিকাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের কাজ শুরু করে সৈয়দপুর পৌরসভা। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে পয়ঃবর্জ্য দিয়ে সার উৎপাদন হয় এ প্ল্যান্টে।
সার উৎপাদনের জন্য পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডের প্রতিটি পাড়া-মহল্লার বাড়ি থেকে গৃহস্থালি ও মানববর্জ্য সংগ্রহ করে প্ল্যান্টে নেওয়া হয়। এরপর সেখানে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সলিড ওয়েস্ট, মানববর্জ্য ও কাঠের গুড়া একত্রে মিশিয়ে ৫ ধাপে কো-কম্পোস্ট জৈব সারে রূপান্তরিত করা হয়। মানববর্জ থেকে সার তৈরি হতে সময় লাগে ১২ সপ্তাহ।
মোট ৪টি ভেকুট্যাক গাড়ি ৩৩ হাজার পরিবার ও ৬টি হাট-বাজার থেকে মানববর্জ্য সংগ্রহ করে থাকে।
সৈয়দপুরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলার মোহাম্মদ আলী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, পয়ঃবর্জ্য খালি করতে পৌরসভায় লিখিত আবেদন করলেই বাসার সামনে চলে যায় বিশাল ট্যাঙ্কিসহ গাড়ি। ট্যাংক পরিস্কার করতে যে অর্থ পাওয়া যায়, তা পৌরসভার রাজস্ব তহবিলে জমা হয়। তা দিয়েই বেতন হয় সুইপার ও ড্রাইভারের।
প্ল্যান্টে উৎপাদিত সার কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে জাতীয় পদক পাওয়া সৈয়দপুরের কৃষক আহসানুল হল বাবু তার ড্রাগন ফলের বাগান ও ধানক্ষেতে ব্যবহার করছেন এই সার। এখন পর্যন্ত আড়াই টন সার কিনেছেন তিনি।
আহসানুল হক বাবু টিবিএসকে বলেন, "এ অঞ্চলের মাটিতে জৈব অংশ নাই। মাটির প্রাণ, জৈব ফেরাতে এ সার কিনেছি। সার দেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে বাগানের রঙ গাড়ো সবুজ হয়েছে। এখন কী পরিমাণ ফুল ফল আসে, দেখা যাক।"
এ সার ব্যবহারে মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক কাজ করছে এসকেএফ ফাউন্ডেশন। প্রকল্প সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "এই সার সৈয়দপুরের ১৩২টি পারিবারিক পুষ্টিবাগানে ও ৭৪ জন কৃষকের ক্ষেতে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০ টন সার উৎপাদিত হয়েছে। শুরুতে কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে ফ্রিতে সার দেওয়া হতো। প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে ২০ টন সার বিক্রি হয়েছে, এখন সাত-আট টন সার হাতে আছে। কৃষকদের মধ্যে দিন দিন এ সার ব্যবহারের আগ্রহ বাড়ছে।"
এর আগে, ২০১৫ সালে টাঙ্গাইলের সখীপুরে প্রথম ফিকাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করে ওয়াটার এইড। ওই প্ল্যান্ট থেকে বছরে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় ৭২০ টন জৈব সার। সেই সার ১৫ টাকা কেজি দরে সখীকম্পোস্ট নামে বাজারজাত করা হচ্ছে।
সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সখীপুর পৌরসভা মডেল হিসেবে মনোনীত হয়েছে।
ওয়াটার এইডের প্রোগ্রাম অফিসার ইঞ্জিনিয়ার শাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত শুধু সৈয়দপুর পৌরসভার বর্জ প্ল্যান্টে সার তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ প্ল্যান্ট থেকে ৩৭৯ টন সার উৎপাদন সম্ভব।
তিনি জানান, "এখন পর্যন্ত আমাদের সক্ষমতার মাত্র ১৫ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। আমাদের যে সক্ষমতা, তা দিয়ে পৌরসভার বাইরের বর্জ্যও ব্যবহার করা সম্ভব।"
"আমরা সৈয়দপুর পৌরসভাকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছি। ধীরে ধীরে পৌরসভাকে এ প্ল্যান্টের পুরো দায়িত্ব দেওয়া হবে। সৈয়দপুর ও সখীপুর একটি মডেল; সরকার এই মডেল সব পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনে ব্যবহার করতে পারে," বলেন শাখাওয়াত।
১৭০ শতক জমির ওপর গড়ে ওঠা সৈয়দপুর ফিকাল স্লাজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের স্থাপন খরচ ছিল ৭ কোটি টাকা। শুরুতে এর পরিচালন ব্যয় আড়াই লাখ টাকা হলেও এখন তা কমে দেড় লাখে নেমে এসেছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম গত বছর সৈয়দপুর প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন।
টিবিএসকে তিনি বলেন, "সৈয়দপুরের ওই প্ল্যান্টের কার্যক্রম ভালো। তবে ঢাকার মত মেগা সিটিতে সেটি বাস্তবায়ন করা কঠিন। আমরা সারা দেশে পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়েছি।"