বিদেশি ফলের দাম চড়া, রমজানে আশির্বাদ হয়ে এসেছে দেশীয় ফল
দাম বেড়ে যাওয়ায় সব ধরনের খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যখন বিদেশি ফলও চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে তখন আমাদের জন্য আশির্বাদ হয়ে উঠেছে দেশে উৎপাদিত, বরই, পেয়ারা, তরমুজের মত ফলগুলো।
ভালো উৎপাদনে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় দেশীয় এই ফলগুলোর স্থিতিশীল দামের কারণে ফলের চাহিদা পূরণে সাধারণ মানুষ এসব ফলেই এখন নির্ভরতা বাড়াচ্ছে।
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, শুল্ক বেড়ে যাওয়া, এলসি জটিলতাসহ নানা কারণে উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে বিদেশি ফল। আসন্ন রমজানেও বিদেশি ফলের দাম কমার বদলে দেখা যাচ্ছে উল্টো বাড়ার প্রবণতা। যে কারণে আঙ্গুর, আপেল, মাল্টার পরিবর্তে বিকল্প হয়ে উঠেছে দেশি ফল।
তবে রমজান উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেলে কোথাও কোথাও দেশি ফলের দাম ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে বলে জানা গেছে।
ফল আমদানিকারক ও বিক্রেতাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, উচ্চমূল্যের বিদেশি ফলের বাজারে সহনীয় মূল্যে পেয়ারার পাশাপাশি বিক্রি হচ্ছে কুল বা বরই। পেয়ারা বছরজুড়ে মিললেও বরই এর ভরা মৌসুম শেষ হওয়ার পথে। তবে এরই মাঝে বাজারে এসেছে তরমুজ। প্রতিটি বাজারই এখন তরমুজ, আনারসে ভরপুর। দামও স্বাভাবিক।
ব্যবসায়ী ও ভোক্তারা বলছেন, পেয়ারা, বরই, তরমুজের উপরই এবার বেশিরভাগ মানুষ ভরসা করছে। ফলগুলোর উৎপাদনও বেশ ভালো হয়েছে, আবার দামও সাধ্যের মধ্যে। আগাম তরমুজ কিছুটা বেশি দামে বিক্রি হলেও সরবরাহ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা কমতে শুরু করেছে।
বাড্ডার বাসিন্দা নাজমুল করিম শুভ বেসরকারি চাকরিজীবি। তিনি টিবিএসকে বলেন, "প্রায় দেড় বছর হয়েছে আপেল কেনা ছেড়েছি। এখন বিদেশি ফল কিনলেই ২৫০ টাকা বা তারও বেশি লাগে। পরে ভাবলাম, দরকার কী। এখন পেয়ারা, কলা, নানা জাতের বরই, তরমুজ এসবই খাচ্ছি। এর পরেই তো আম লিচু আসবে।"
বর্তমানে বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি বরই বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৬০-৮০ টাকায়। যেখানে পেয়ারা পাওয়া যাচ্ছে ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে। একই সময়ে তরমুজের দাম কমে এখন ৪০-৪৫ টাকা কেজি দরেই ঢাকার বেশিরভাগ স্থানে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারে আসতে শুরু করেছে মৌসুমী আনারস। এর বাইরে কলা, পেঁপে, সফেদা, বেল রয়েছে বাজারে। এই দেশি ফলগুলোই এবারে নির্ভরতার বড় জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কলার ডজন বিক্রি হচ্ছে মান ও জাতভেদে ৫০-১০৫ টাকার মধ্যে। যেখানে প্রতি কেজি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৬০-১২০ টাকায়। আর আকারভেদে আনারস বিক্রি হচ্ছে ২০-৫০ টাকায়।
দেশে উৎপাদিত বিদেশি ফলের মধ্যে ড্রাগন ও স্ট্রবেরি রয়েছে বাজারে।
ঢাকা মহানগর ফল আমদানি রপ্তানিকারক ও আড়তদার ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল করিম বলেন, "দেশি ফলের উৎপাদন বেশ ভালো। অনেক বিদেশি ফলও এখন বাংলাদেশে উৎপাদিত হচ্ছে। যে কারণে বিদেশি ফলের দাম বেশি হলেও মানুষ নির্ভরতা বাড়িয়েছে স্থানীয় ফলগুলোতে।"
তিনি বলেন, "উৎপাদন ভালো হওয়ার কারণে মৌসুমি ফলগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকে এবং দামও থাকে স্থিতিশীল। এ কারণেই ক্রেতারাও এসব ফল কিনছেন বেশি।"
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বড়ই উৎপাদন হয়েছে ১.৭৬ লাখ টন, পেয়ারা ৪.২৮ লাখ টন, কলা ২৯.৭৮ লাখ টন, তরমুজ ২৫.৮৭ লাখ টন এবং পেঁপে ৭.১৩ লাখ টন।
এই অর্থবছরে দেশীয় ফলের মোট উৎপাদন ছিল ১.৪০ কোটি টন। যা ২০১৪-১৫তে ছিল ১.০৬ কোটি টন। চলতি অর্থবছরে ফলের উৎপাদন এক লাখ টন বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান কর্মকর্তারা।
এই কয়েক বছরের মধ্যে বরই, কলা, তরমুজ, ড্রাগন ও স্ট্রবেরির সহ বেশকিছু ফলের উৎপাদন বেড়েছে।
দেশি ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কৃষি খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, সারাদেশে এখন পেয়ারা, বরই, উন্নত জাতের কলা, ড্রাগন, স্ট্রবেরি, আম সহ বিভিন্ন ফলের উৎপাদনে ভালো বিনিয়োগ করেছেন উদ্যোক্তারা। এসব উদ্যোক্তাদের কারণেই দেশের ফল উৎপাদন এখন একটা ভালো অবস্থায় পৌঁছেছে।
পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ টিবিএসকে বলেন, "ফলের বাগান করে কৃষি উদ্যোক্তারা লাখ লাখ টাকা আয় করছেন। কমার্শিয়াল উৎপাদনে যে আয় করছেন সেটা সাধারণ কৃষিতে সম্ভব নয়। আর এই উদ্যোক্তাদের জন্যই আজ সারা বছর পেয়ারা পাওয়া যায়, বাজারে ব্যাপকহারে বড়ই পাওয়া যাচ্ছে। ড্রাগন, মাল্টার মত বিদেশি ফল মিলছে।"
এদিকে ফলের বাজার ঘুরে দেখা যায়, বিদেশি ফলের বাজারে ২০০ টাকার নিচে কোন ফল নেই। প্রতি কেজি সবুজ আপেল বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকা, লাল আপেল ২৬০-৩২০, কমলা ২০০-২২০, সাদা আঙ্গুর ২২০-২৫০, লাল ও কালো আঙ্গুর ৩৫০-৪০০ টাকা, বড় আনার ৩০০-৪০০ টাকা এবং মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ২০০-২৫০ টাকায়। বছর দুয়েক আগেও আমদানি হওয়া এই ফলগুলোর বেশিরভাগই স্থানীয় বাজারে ১৫০-২০০ টাকার মধ্যেই বিক্রি করতে দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদেশি ফলের মধ্যে আপেল, কমলা, ম্যান্ডারিন, আঙ্গুর ও নাশপাতি আমদানি হয়েছে ৯৩.৩৬১ হাজার টন, যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই ফলগুলো আমদানি হয়েছে ১.৩০ লাখ টন।
এছাড়া এ বছর খেজুরের আমদানিও ব্যাপক হারে কমেছে। যে কারণে বাজারে গত বছরের তুলনায় ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে খেজুর বিক্রি হচ্ছে।
আসন্ন রমজানে ৫০ হাজার টন খেজুরের চাহিদা রয়েছে বলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফল আমদানির জটিলতা নেই, তবে খরচ বেশি। যে কারণে বিদেশি ফলের দাম চড়া।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "আগে ২০ কেজি আপেলের প্যাকেটে শুল্ক দিতে হতো ৩০০ টাকা, এখন সেটা ১৪০০ টাকা। এক কেজি আঙ্গুরে দিতে হতো ৩০ টাকা, এখন সেটা ১০০ টাকা। আবার ডলারের রেট বেশি। সব মিলে খরচও বেশি।"
তিনি বলেন, "এই অবস্থায় আমাদের চিন্তা করার কারণ নেই। কারণ পেয়ারা, কলা, আনারস, পেঁপে সারাবছরই পাওয়া যায়। মানুষও এখন এগুলো বেশি করে কিনছে। আবার বিদেশি ফল হিসেবে সবুজ মাল্টা, ড্রাগন এগুলো তো দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। বিদেশি ফলে নির্ভরতাও কমে যাচ্ছে, আমদানিও কমছে।