ঢাকা বিমানবন্দরের আয় থেকেই ক্ষতি কাটিয়ে উঠেছে দেশের ৫ অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলো অনেকাংশেই রাজধানী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আয়ের উপর নির্ভরশীল।
বর্তমানে দেশে চালু ৮টি বিমানবন্দরের মধ্যে তিনটিতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চললেও, বাকি পাঁচটিতে শুধুমাত্র অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলে।
সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অফ বাংলাদেশের (সিএএবি) তথ্য অনুযায়ী, সংস্থাটি ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রায় এসব বিমানবন্দর পরিচালনা করে ১,৯১১ কোটি টাকা আয় এবং সংশ্লিষ্ট ফ্যাসিলিটিগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য প্রায় ৯৬০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে।
মোট রাজস্বের ১,৫৯৭ কোটি টাকা আয় হয়েছে দেশের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে। অন্য সাতটি বিমানবন্দর মাত্র ৩১৪ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে সক্ষম হয়েছে, যা ঢাকা বিমানবন্দরের আয়ের তুলনায় খুবই কম।
চলতি বছর তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন হলে ঢাকা বিমানবন্দরের আয় আরও বাড়বে বলে আশা করছে কর্তৃপক্ষ।
যদিও দেশে বিদ্যমান অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলো লাভজনক নয়, তারপরও 'জনস্বার্থ' এবং বিমান ভ্রমণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ধীরে ধীরে ছয়টি বন্ধ বিমানবন্দর পুনরায় চালু করার কথা বিবেচনা করছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়।
সিএএবি'র চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলো পরিচালন ব্যয় মেটানোর মতো পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় করে না। রাজস্ব তৈরির জন্য আরও কার্যক্রম প্রয়োজন।"
"মূলত, আমরা জনস্বার্থে এগুলো পরিচালনা করছি। ভবিষ্যতে সরকার যদি বন্ধ বিমানবন্দরগুলো খোলার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আমরা ভর্তুকি দিয়ে সেগুলো পরিচালনা করব," তিনি যোগ করেন।
বিমানবন্দরের আয়ের উৎস ব্যাখ্যা করে সিএএবি চেয়ারম্যান বলেন, বিমানবন্দরে দুই ধরনের আয় হয়- অ্যারোনটিক্যাল এবং নন-অ্যারোনটিক্যাল।
তিনি বলেন, "অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের নন-অ্যারোনটিক্যাল সেক্টরের আয় খুব কম। বিমানবন্দরের ভেতরে অল্প কিছু দোকান রয়েছে। অবকাঠামোও তেমন বড় নয়," তিনি বলেন।
এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান আরেকটি সমস্যার কথা তুলে ধরে বলেন, বিমানবন্দরগুলোর অর্গানোগ্রামে প্রয়োজনীয় জনবলের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।
"এর ফলে, আমাদের অতিরিক্ত জনবলের জন্য বাড়তি খরচ করতে হবে। যেমন, আমাদের প্রকৌশল এবং অপারেশনাল দিকে জনশক্তি আউটসোর্স করতে হবে। এই ক্ষেত্রগুলো থেকে তেমন আয় হয় না," তিনি বলেন।
"শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকেই রাজস্বের একটি বড় অংশ উঠে আসে। এর মাধ্যমেই জনস্বার্থে আমরা অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরগুলো পরিচালনা করছি," যোগ করেন সিএএবি চেয়ারম্যান।
অন্য দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর- চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও স্বল্প পরিসরে লাভের মধ্যে রয়েছে।
বর্তমানে কক্সবাজার, রাজশাহী, যশোর, সৈয়দপুর ও বরিশালের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর চালু রয়েছে।
এদিকে, আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে বিমানবন্দরগুলোতে সরকারের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করার কার্যক্রম চলছে।
সিএএবি সূত্রে জানা গেছে, জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু করলেও আর্থিক অবস্থার কারণে সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক সেটআপে রূপান্তরের প্রক্রিয়া বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ধারণা, ফ্লাইট বাড়লে তা বিমানবন্দরগুলোর রাজস্ব বাড়াতে সহায়তা করবে।
"যাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লে রাজস্ব বাড়বে। বিমানবন্দরের আয় বাড়লে রাজস্ব অবশ্যই বাড়বে," বলেন তিনি।
আয়ের প্রবণতা বর্তমানে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় কর্তৃপক্ষ আশা করছে অদূর ভবিষ্যতে উন্নত ব্যবস্থাপনা এবং বিমান ও যাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি পাবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বিমানবন্দরগুলো সংযোগ ও অর্থনৈতিক বৃদ্ধিতেও ভূমিকা পালন করে।
তাই রাজস্ব কম আসলেও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য লাভ বিবেচনায় রাখতে হবে। এ কারণে তারা দেশের অন্যান্য বন্ধ বিমানবন্দরগুলো পুনরায় চালু করার দাবি জানান।
ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের জেনারেল ম্যানেজার (মার্কেটিং সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন) মো. কামরুল ইসলাম বলেন, "যখন একটি বিমানবন্দর চালু হয়, তখন নতুন সংযোগের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর ত্বরান্বিত হয়। কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। তাই, এই বিষয়গুলো সরকার কর্তৃক রাজস্ব আয়ের বাইরেও গণনা করা হয়।"
বিমানের উড্ডয়ন এবং অবতরণের জন্য অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর কারণে বাংলাদেশের এগারোটি অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের মধ্যে ছয়টি বিমানবন্দর বাণিজ্যিকভাবে চালু করা হয়নি।
তবে, পর্যটকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকায় এবং নতুন কিছু রিসোর্ট চালু হওয়ায় ঈশ্বরদী বিমানবন্দর এবং সিলেটের শমশেরনগর বিমানবন্দর পুনরায় চালু করতে চায় সংশ্লিষ্টরা।
বহু বছর ধরে বন্ধ থাকা ঠাকুরগাঁও বিমানবন্দর, বগুড়া বিমানবন্দর, লালমনিরহাট বিমানবন্দর, কুমিল্লা বিমানবন্দর এবং শমশেরনগর বিমানবন্দর- সবগুলোই দুর্বল অবকাঠামো এবং যাত্রী সংকটের কারণে বন্ধ রয়েছে।
তাছাড়া, এরমধ্যে বেশিরভাগ অভ্যন্তরীণ বিমানঘাঁটি ব্রিটিশ আমলে নির্মিত। পাকিস্তান আমলে বাণিজ্যিকভাবে চলতো এগুলোর কার্যক্রম।
এই বিমানবন্দরগুলো পুনরায় চালুর ওপর গুরুত্বারোপ করে বিমান বিশেষজ্ঞ উইং কমান্ডার (অবসরপ্রাপ্ত) এটিএম নজরুল ইসলাম বলেন, "১৯৯১ সালে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীর সংখ্যা ছিল তিন লাখ, যা ২০১৯ সালে ২৫ লাখে পৌঁছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীর সংখ্যা ১১ লাখ থেকে বেড়ে ৮৬ লাখ হয়েছে।"
তিনি আরও বলেন, ১৯৯৯ সালে প্রায় ৭০,০০০ টনের কার্গো আকাশপথে চলতো, ২০১৯ সালে তা ৩.৫৮ লাখ টনে পৌঁছে।
যেভাবে ঢাকা বিমানবন্দর অন্য বিমানবন্দরের ক্ষতি কাটাতে সহায়তা করেছে
গত পাঁচ বছরে (২০১৮-২০২২ অর্থবছর) ঢাকা বিমানবন্দর যথাক্রমে ১,০৯৩.৬৫ কোটি টাকা, ১,১১৭.২৭ কোটি টাকা, ৮৭৯.৩৪ কোটি টাকা, ৫৯৮.৭৭ কোটি টাকা এবং ১,১৯৩.৭২ কোটি টাকা লাভ করেছে।
শুধুমাত্র ঢাকা বিমানবন্দরের আয় দিয়েই সরকারের একটি রাজস্ব সহায়ক সংস্থায় পরিণত হয়েছে সিএএবি।
ঢাকা বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক উইং কমান্ডার কামরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "কার্গো ফ্লাইট ছাড়াই শাহজালাল বিমানবন্দর প্রতিদিন প্রায় ১৬০টি আন্তর্জাতিক এবং ১৭০টি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করে।"
এছাড়া কিছু সাধারণ এভিয়েশন হেলিকপ্টার রয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ৩৫০টি ফ্লাইট চলাচল করে।
গড়ে প্রায় ৩০,০০০ যাত্রী বিমানবন্দরটি ব্যবহার করেন। এছাড়া কার্গো ফ্লাইটে বহন করা হয় শত শত টন পণ্য।
বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক বলেন, "আমাদের বার্ষিক আয় সেলফ সাস্টেইনিং এবং দেশে বেসামরিক বিমান চলাচলের আয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে এই বিমানবন্দর।"
তৃতীয় টার্মিনালে আয় আরো বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, "ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়বে। একইভাবে রপ্তানি-আমদানি কার্গোও বাড়বে। অন্যান্য সুবিধাও বাড়বে। তখন নন-অ্যারোনটিক্যাল আয়ও বাড়বে।"
তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণে যে টাকা খরচ হয়েছে তা বিমানবন্দরের নিজস্ব আয় থেকে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
বিমানবন্দর এবং এরোড্রোমগুলোর নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণকারী সিএএবি বিভিন্ন এরোড্রোম চার্জ ছাড়াও এম্বার্কেশন, রুট নেভিগেশন সহ প্রাসঙ্গিক পরিষেবাগুলোর জন্য চার্জ করে।
এম্বার্কেশন ফি প্রস্থানরত যাত্রীরা পরিশোধ করে এবং তারা টিকিট কেনার সময় এয়ারলাইন সেই ফি সংগ্রহ করে। আন্তর্জাতিক যাত্রীদের জন্য এই ফি ৫০০ টাকা, অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের জন্য ৫০।
এয়ারলাইন অপারেটররা এরোড্রোম চার্জ যেমন ল্যান্ডিং চার্জ, পার্কিং এবং হাউজিং চার্জ, বোর্ডিং ব্রিজ ফি, সিকিউরিটি চার্জ, রুট নেভিগেশন ফ্যাসিলিটি চার্জ এবং ফ্লাইটের জন্য নির্ধারিত সময়ের বাইরেও চার্জ দেয়।
পদ্মা সেতুর কারণে বরিশাল ও যশোর বিমানবন্দরের ব্যবসায় প্রভাব পড়ছে
সম্প্রতি পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে বরিশাল ও যশোর- এ দুটি বিমানবন্দরে যাত্রী সংখ্যায় প্রভাব পড়েছে।
সিএএবি'র চেয়ারম্যান এম মফিদুর রহমান বলেন, "পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর বরিশাল বিমানবন্দরে যাত্রীর সংখ্যা কমে গেলেও অপারেশনাল খরচ তো কমেনি। ফলে আমরা রাজস্ব হারাচ্ছি।"
যশোর বিমানবন্দরের একজন কর্মকর্তা জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে বিমানবন্দরে দৈনিক ১৭ থেকে ১৮টি ফ্লাইট চলতো, বর্তমানে চলে ৭টি।
এ কর্মকর্তা অবশ্য বলেন, তারা আশা করছেন সামনে ফ্লাইটের সংখ্যা বাড়বে।
গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং থেকে প্রাপ্ত লভ্যাংশ চায় সিএএবি
বর্তমানে, বিভিন্ন বিমানবন্দরে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং পরিচালনা করে বিমান বাংলাদেশ, বছরে গড়ে ১,৫০০ কোটি টাকা আয় করে।
এই আয় থেকে লভ্যাংশ চায় সিএএবি।
"আমরা বিমানের আয় থেকে সিভিল এভিয়েশনের অংশটা পাই না। যদি আমরা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলার ব্যবহার করি বা যদি এটি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করা হয় যে বিমান আমাদের সাথে প্রতিটি চার্জে লভ্যাংশ ভাগ করে নেবে, তাহলে বিমানবন্দরগুলোর আয়ও বাড়বে," বলেছেন ক্যাব চেয়ারম্যান।
"সিভিল এভিয়েশন এয়ারপোর্ট তৈরি করছে। তাই যারা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করছে তাদের আয়ের লভ্যাংশ ভাগ করে নেওয়া উচিত," যোগ করেন তিনি।
বেসামরিক বিমান চলাচলের সামগ্রিক ক্ষতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, "করোনাভাইরাস সংকটের সময় আমরাই একমাত্র সংস্থা যারা সরকারকে অতিরিক্ত ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছি। এমনকি গত অর্থবছরেও আমরা অতিরিক্ত ৬০০ কোটি টাকা দিয়েছি।"