পানির জন্য কাঁদল বঙ্গবাজার!
একশটির বেশি খাল ছিল ঢাকায়, আর পুকুর ছিল তিনশ। বুড়িগঙ্গা ছাড়াও ছিল নড়াই, বালু নদী আর পাণ্ডু। এসবই অবশ্য হাজার বছর আগের কথা। কিন্তু সেই অতীতের মতো এখনো যদি এ শহরে সব নদী-পুকুর-খাল আগের মতোই থাকত, তবে সিদ্দিকবাজার বা বঙ্গবাজারে আগুন লাগলে দিশেহারা হয়ে পড়তে হতো না দমকল কর্মীদের। আগুন নেভানোর প্রধান উপকরণ পানি, কিন্তু ধারেকাছে যদি জলাশয়ই না থাকে, তাহলে আগুন নিভবে কী করে! ব্রিটিশ আমলেও পুকুর, খাল ভরাট নিষিদ্ধ ছিল পুরোই। বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তো দারুণ কড়াকড়ি ছিল। কারণ বোমার ঘায়ে আগুন জ্বলে উঠলে নেভানোর জন্য শেষ ভরসা ওই পানিই।
তাইতো ঢাকা গবেষক হাশেম সূফী বলছিলেন, 'আজকের ঢাকাকে দেড়-দুইশ বছর আগে বসিয়ে দিন। পুকুর আর খালের ধারে উঁচুউঁচু ভবন, ভাবতেও ভালো লাগছে দেখুন। উন্নত দেশগুলোয় শহরের বিভিন্ন স্থানে জলাশয় তৈরি করা হয় কেবল সৌন্দর্য রক্ষার জন্যই নয়, শহর রক্ষার জন্যও।'
মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দেশের অন্যতম প্রধান কাপড়ের বাজার বঙ্গবাজার পুড়ে যায় ভয়াবহ আগুনে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ৪৮টি ইউনিটের সময় লাগে সাড়ে ছয় ঘণ্টা। ততক্ষণে পাঁচ হাজার দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে (দোকান মালিক কর্তৃপক্ষের দাবী অনুযায়ী)। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ মাইন উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বেলা সাড়ে বারোটার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে তবে পুরোপুরি নেভাতে লাগবে আরও ঘণ্টাখানেক সময়।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক জানান, ২০১৯ সালের ২ এপ্রিল বঙ্গবাজারের এ ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। একটি ব্যানারও টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভবনের গায়ে। এরপর নোটিশ দেওয়া হয়েছে ১০ বার। কিন্তু সবই উপেক্ষা করা হয়েছে।
মহাপরিচালক আরও বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে দেরি হওয়ার একটি প্রধান কারণ পানির সংকট। তার ভাষায়, এক জায়গায় আগুন নেভাচ্ছি, আরেক জায়গায় আগুন লেগে যাচ্ছে।
মোট ছয়টি দিক দিয়ে পানি ছিটানো হয়েছে আগুনের ওপর। পানির চাপ কম থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ভোগান্তিতে পড়েছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। পানি ঢালা হয়েছে হেলিকপ্টার থেকেও। পানির উৎস হিসেবে কাজে লাগানো হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের পুকুর এবং হাতিরঝিল।
আগুন লাগার খবর শুনে প্রচুর লোক ভিড় করেন বঙ্গবাজারের আশপাশে। তারা মোবাইল ফোনে আগুনের ভিডিও তুলতে থাকেন। তখন একজনকে বলতে শোনা গেছে, 'আল্লাহর ওয়াস্তে ভিডিও না করে পানির ব্যবস্থা করুন।'
হাশেম সূফী বলেছিলেন, ঢাকায় তিন মালিকানার পুকুর ছিল: ব্যক্তিগত, পঞ্চায়েত, আর সরকারি। পঞ্চায়েত পুকুরগুলো ছিল জনকল্যাণের জন্য। আবার ব্যক্তিগত অনেক পুকুরও ওয়াকফ করা হয়েছিল। কিন্তু এখন তো পুকুরই নেই — মানে সব মিলিয়ে ৩০টির মতো পুকুর থাকতে পারে ঢাকায়। অথচ ভবন সংখ্যা ছয় লক্ষ এ শহরে, বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহারের অযোগ্য। মানুষের জন্য কতটা অনিরাপদ হয়ে উঠছে এ শহরটা, তা বোঝা আর দুষ্কর নয়!