তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে দেশজুড়ে আবারও লোডশেডিং
তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যে দেশজুড়ে আবারও লোডশেডিং শুরু হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর দ্বারা রেকর্ড পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন সত্ত্বেও দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প উৎপাদন, কৃষি সেচ এবং দৈনন্দিনের গৃহকর্ম।
বাংলাদেশ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, শনিবার (১৫ এপ্রিল) সারাদেশে দিনের বেলায় ২,৫০০ মেগাওয়াট (মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ পরিমাণ লোডশেডিং হয়েছে; একই দিনে রাতেরবেলা পিক আওয়ারে দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল ৯৫০ মেগাওয়াট।
রেকর্ড ১৫,৩০০ মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদনের পর, রামপাল বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি (৬৬০ মেগাওয়াট) হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শনিবার দেশের সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন আবারও ১৫,০০০ মেগাওয়াটের নিচে নেমে আসে।
এদিকে, শনিবার সারাদেশে ১৫,৫০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে মোট বিদ্যুৎ সরবরাহের পরিমাণ ছিল ১৩,৯৬৯ মেগাওয়াট। গত বছরের একই দিনের তুলনায় সরবরাহ ছিল ১০০ মেগাওয়াট বেশি।
গাজীপুরের মিরাবাজার এলাকার বাসিন্দা মোঃ ইব্রাহিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে (টিবিএস) বলেন, "দিনের বেলায় লোডশেডিং বেশি হয়, অন্তত চারবার; ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না। রাতে ঘুম কম হয়, এরকম প্রচণ্ড গরমে বিদ্যুৎ ছাড়া ঘুমানো খুব কঠিন।"
রোববার (১৬ এপ্রিল) ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে; তাপমাত্রার পারদ উঠেছে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। আগামী ৭২ ঘণ্টা এই তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর।
পর্যাপ্ত উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও সারাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছে বিপিডিবি। তাপপ্রবাহ ও কৃষি সেচের জন্য বাড়তি চাহিদার পাশাপাশি তারল্য সংকটের কারণে ফার্নেস অয়েল-চালিত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সম্পূর্ণরূপে কাজে লাগাতে না পারায় বিদ্যুতের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে না বলে টিবিএসকে জানিয়েছে বিপিডিবি সূত্র।
তবে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি)-এর দাম কমায় এবং নতুন চালু হওয়া কয়লা-ভিত্তিক প্ল্যান্ট বিদ্যুৎ উৎপাদনে অনেকটাই অবদান রাখছে। অন্যথায়, লোডশেডিং পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো বলে জানায় সূত্র।
বিপিডিবির সদস্য (জেনারেশন) এস এম ওয়াজেদ আলী সরদার টিবিএসকে বলেন, তারা লোডশেডিং এড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।
তিনি বলেন, "রমজানের পরের কয়েকটা দিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই মাসের শেষে বিদ্যুতের চাহিদা ২,০০০ মেগাওয়াট কমবে; কারণ তখন সেচের জন্য বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে।"
এদিকে, তারল্য সংকট ও পেমেন্ট জটিলতায় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকেরা তাদের ফার্নেস অয়েল-চালিত পাওয়ার প্ল্যান্টের সর্বোচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছেন না।
বর্তমানে ফার্নেস অয়েল-ভিত্তিক পাওয়ার প্ল্যান্টের লোড ফ্যাক্টর (পাওয়ার প্ল্যান্টের সক্ষমতা ব্যবহারের হার) প্রায় ৫০ থেকে ৫৫ শতাংশ, যা অন্তত ৬৬ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
বিপিডিবি থেকে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের প্রদেয় পরিশোধ করা হলে লোডশেডিং ন্যূনতম পর্যায়ে নেমে আসবে বলে জানান শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা এখন পর্যন্ত গত অক্টোবরের বিল পায়নি।
লোডশেডিংয়ে ব্যাহত কৃষি সেচ
লোডশেডিংয়ের কারণে গত কয়েকদিন ধরে ধানক্ষেতের সেচ কাজ ব্যাহত হচ্ছে, যা চলতি বোরো মৌসুমে ধান উৎপাদনে ফেলতে পারে বিরূপ প্রভাব।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার হাটুয়া এলাকার কৃষক সবুজ কুমার সরকার একটি গভীর ও দুটি অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ৩২০ বিঘা জমিতে চাষ করছেন।
কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ করে লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ায় ধানক্ষেতে পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছেন না বলে জানান।
"পরিস্থিতি এমন হবে, তা আমরা বুঝতে পারিনি। তীব্র গরমের কারণে জমি দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে; ঘন ঘন পানি দেওয়া প্রয়োজন। এখন আমি কী করব?" হতাশ হয়ে বললেন সবুজ কুমার।
রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বেণীপুর গ্রামের আরেক কৃষক মাজহারুল ইসলাম তিন বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেছেন। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মধ্যে তিনিও জমিতে পর্যাপ্ত পানি দিতে পারছেন না; এতে করে ফসলের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন তিনি।
সম্প্রতি গোদাগাড়ীর নিমঘুটু গ্রামের এক আদিবাসী কৃষক তার ধানক্ষেতে পানি দিতে না পেরে, হতাশ হয়ে কয়েকদিন আগে বিষ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।
লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত শিল্প উৎপাদন
চট্টগ্রাম নগরীতে ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন চালু রাখার চেষ্টা করছেন কারখানা মালিকরা। এতে জ্বালানি খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদন অব্যাহত রাখা নিয়ে তারা শঙ্কায় পড়েছেন।
চট্টগ্রামের একাধিক পোশাক কারখানা মালিক জানিয়েছেন, ঈদের ছুটির আগে কারখানায় কাজের বাড়তি চাপ থাকে। ঈদের আগে শিপমেন্ট করার জন্য দিনরাত কারখানা চালু রাখতে হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে গার্মেন্টসে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে সময়মতো পণ্যের ডেলিভারি দেওয়া নিয়ে তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) পরিচালক সামছুল আজম টিবিএসকে বলেন, গার্মেন্টস কারখানায় ১০ ঘন্টা উৎপদন প্রক্রিয়ার মধ্যে ৬ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। ফলে জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চালু রাখতে হচ্ছে। কারখানায় জেনারেটরের জ্বালানি বাবদ স্বাভাবিক সময়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু শনিবার কারখানায় ডিজেল বাবদ ৬০ শতাংশ বেশি ব্যয় হয়েছে।
এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি যন্ত্রাংশেরও ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে বলে জানান তিনি।
বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ চট্টগ্রাম দক্ষিণাঞ্চলের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট।
চট্টগ্রাম বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী এম রেজাউল করিম টিবিএসকে বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতির কারণে লোডশেডিং হচ্ছে। চাহিদার বিপরীতে রোববার (১৬ এপ্রিল) তারা মাত্র ১,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ পেয়েছেন।
এদিকে, নারায়ণগঞ্জ-ভিত্তিক নিটওয়্যার কারখানা ফতুল্লা অ্যাপারেলসও লোডশেডিংয়ের সঙ্গে লড়াই করছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফজলে শামীম এহসান বলেন, বৃহস্পতিবার ৬ বার লোডশেডিং হয়েছে কারখানায় এবং একবার তা দুই ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
(চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী এবং খুলনা থেকে আমাদের সংবাদদাতারা এই প্রতিবেদনে অবদান রেখেছেন)