ক্রিটিক্যাল ক্যানসার চিকিৎসাসেবায় আগ্রহী হচ্ছে বেসরকারি খাত
বাংলাদেশে প্রতিবছর ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়লেও এসব রোগীর বেশিরভাগই মানসম্মত চিকিৎসা পান না। এমন পরিস্থিতিতে দেশে উচ্চমানের ক্যানসার চিকিৎসায় আরও বিনিয়োগ করতে যাচ্ছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা।
বেসরকারি এসব উদ্যোগের অনেকগুলোই ক্যানসার চিকিৎসার ক্রিটিক্যাল খাতগুলোতে সেবার মান বাড়ানোয় নজর দিচ্ছে।
১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি মালিকানাধীন দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার হাসপাতাল জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা সীমিত।
অপর্যাপ্ত চিকিৎসাসুবিধা ও হাসপাতালগুলো নিয়ে রোগীদের আস্থার অভাবের কারণে ক্যানসার চিকিৎসায় বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাও ক্রমবর্ধমান।
তবে এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দেশের ভেতরেই ক্যানসার চিকিৎসার একটি পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা এগিয়ে আসছেন।
চিকিৎসকেরা জানান, দেশে ক্যানসার চিকিৎসা এখন ক্রমশ আধুনিক হচ্ছে। রোবোটিক সার্জারি, টার্গেটেড থেরাপিসহ বিভিন্ন ধরনের আধুনিক চিকিৎসাসুবিধা এখন দেশেই রয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় গড়ে ওঠা বেশকিছু হাসপাতালও এসব অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ক্যানসার এপিডেমিওলজিস্ট ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সরকারি হাসপাতালগুলোতে ক্যানসার চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা কম। তাই আমাদের প্রয়োজন বেসরকারি হাসপাতালের।'
তবে বেসরকারি হাসাপালে চিকিৎসাব্যয় বেশি স্বীকার করে তিনি বলেন, এ খরচ কমাতে ও ক্যানসারের চিকিৎসাকে আরও সহজলভ্য করতে সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ডা. রাসকিন বড় উদ্যোক্তাদেরকে ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় বিনিয়োগে বিবেচনা করার আহ্বান জানান।
'আমাদের অনেক বড় বড় ব্যবসায়ী আছেন যারা বৃহৎ প্রকল্পে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। দেশে ক্যানসার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ বিদেশে ব্যয়বহুল এ চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন। অথচ দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা থাকলে অনেক কম খরচে ক্যানসার চিকিৎসা সম্ভব হতো,' বলেন তিনি।
আর্থিকভাবে সক্ষম অনেকে দেশের ক্যানসার চিকিৎসার ওপর আস্থার অভাবে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যান উল্লেখ করে ডা. রাসকিন বলেন, 'দেশেই ক্যানসায় চিকিৎসায় রোগীর আস্থা অর্জন করতে কাজ করতে হবে।'
হৃদরোগের চিকিৎসায় সফলতা
দুই দশক আগেও হৃদরোগের চিকিৎসায় বিশালসংখ্যক রোগী বিদেশে চলে যেতেন। তবে একই সময়ে বেসরকারি উদ্যোগে হৃদরোগের চিকিৎসায় বেশকিছু ডেডিকেটেড হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, এসব হাসপাতাল হৃদরোগের অত্যাধুনিক চিকিৎসাসেবা দেওয়ার মাধ্যমে মানুষের আস্থাও অর্জন করেছে।
বেসরকারি খাত এগিয়ে আসায় সরকারি হাসপাতালগুলোতেও হৃদরোগের চিকিৎসার মানোন্নয়ন ঘটেছে। পাশাপাশি কাজের সুযোগ বাড়ায় হৃদরোগের চিকিৎসায় দক্ষ জনবল তৈরি হয়েছে।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ কার্ডিওভাসকুলার রিসার্চ ফাউন্ডেশন-এর এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে এখন হৃদরোগের ৯৫-৯৮ শতাংশ চিকিৎসার সক্ষমতা রয়েছে।
'হৃদরোগের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য দক্ষ জনশক্তি, আধুনিক প্রযুক্তি এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেশেই রয়েছে,' বলেন প্রধানমন্ত্রী।
ক্যানসার চিকিৎসায় উদ্যোগ
১৯৯১ সালে সরকার দেশের প্রথম ডেডিকেটেড ক্যানসার হাসপাতাল জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে। এরপর বেসরকারি উদ্যোগে ২০০১ সালে ডেডিকেটেড ক্যানসার হাসপাতাল আহ্ছানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল এবং ২০০৪ সালে খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালে ডেল্টা হাসপাতাল এবং ২০২০ সালে ল্যাবএইড ক্যানসার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টার চালু হয়।
প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রাজধানীতে আরও একটি ক্যানসার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে ল্যাবএইড।
এছাড়া আরও বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল — ইউনাইটেড হাসপাতাল, এভায়রকেয়ার, স্কয়ার, ও বিআরবি হাসপাতাল — নিজস্ব ক্যানসার সেন্টারের মাধ্যমে এ রোগের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। ক্যানসার চিকিৎসার মোট তিনটি ধাপের — সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি — চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এ হাসপাতালগুলোতে।
সরকারি পর্যায়ে ক্যানসার ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও সীমিত পরিসরে ক্যানসারের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
তবে সরকার দেশের আটটি বিভাগে ক্যানসার সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুতি নিয়েছে। প্রতিটি সেন্টারের পেছনে সরকার প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয় করছে।
ল্যাবএইড গ্রুপ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. এম. শামিম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত তিন মাসে আমার পরিচিত পাঁচজনের ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন সিঙ্গাপুর এবং দুইজন ভারতে গেছেন চিকিৎসার জন্য। সেখানে তারা কয়েক কোটি টাকা খরচ করেছেন। অথচ আমার হাসপাতালে একই চিকিৎসা আধাকোটি টাকার মধ্যেই হয়ে যেত।'
তিনি আরও উল্লেখ করেন, ক্যানসারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তিন মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত এ চিকিৎসা চলে।
'বিদেশে দীর্ঘসময় থেকে এ চিকিৎসা নেওয়া অনেকের ক্ষেত্রে সম্ভব হয়না। তাই ক্যানসারের চিকিৎসায় আমরা মানুষের আস্থা অর্জনে কাজ করছি। কার্ডিওলজিতে আমরা ইতোমধ্যে মানুষের আস্থা অর্জনে সফল হয়েছি,' বলেন তিনি।
শামিম বলেন, 'আমাদের দেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো ক্যানসার চিকিৎসার ওষুধ বানাচ্ছে। নির্ভুল টেস্ট রেজাল্ট পেতে একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাগার ২০২৩ সালের মধ্যে গড়ে তোলা তোলা হবে।'
এভারকেয়ার হসপিটাল মেডিকেল সার্ভিস-এর প্রধান ডা. আরিফ মাহমুদ বলেন, ক্যানসার চিকিৎসা সেন্টার বাড়ানোর গুরুত্বপূর্ণ, তবে অনকোলজিস্ট, চিকিৎসক, টেকনোলজিস্ট ও ফিজিসিস্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
রোগীদের দেশেই ক্যান্সার চিকিৎসা গ্রহণে উৎসাহিত করার মূল উপায় এটিই বলে মনে করেন এ চিকিৎসক।
ক্যানসার চিকিৎসা রাজধানীকেন্দ্রিক না রেখে দেশের সব বিভাগে সহজলভ্য করার পরামর্শও দেন তিনি।
চট্টগ্রামে আগামী মাসে নিজেদের হাসপাতালে ক্যানসার সেন্টার চালু করতে যাচ্ছে এভারকেয়ার। এর মাধ্যমে বন্দরনগরীতে এটিই প্রথম বেসরকারি উদ্যোগে তৈরি ক্যানসার চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র হবে।
ডা. আরিফ মাহমুদ আরও বলেন, ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের ক্যানসার সেন্টারে ব্যোনম্যারো ট্রান্সপ্ল্যান্টে খরচ হয় ১২-১৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে ভারতে এ খরচ ৫০ লাখ টাকা।
'ক্যানসার বিষয়ে সচেতনতা এবং বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসা দরকার,' বলেন তিনি।
সরকারি হাসপাতালে ক্যানসার ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ক্যানসার সোসাইটির তথ্য বলছে, দেশে আনুমানিক ক্যানসার রোগীর সংখ্যা ১৩ থেকে ১৫ লাখ।
গ্লোবোক্যান ২০২০-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ১.৫৬ লাখ নতুন ক্যানসার রোগী শনাক্ত হয়। এদের মধ্যে ১.০৮ লাখ রোগী ক্যানসারে মারা যান।
বাংলাদেশে ক্যানসার রোগীদের জন্য সরকারি পর্যায়ের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালটিরও পর্যাপ্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। রেডিওথেরাপির ছয়টি মেশিনের মধ্যে পাঁচটিই নষ্ট। চারটি লিনিয়ার এক্সেলেটর মেশিনের মাত্র একটি সচল। ব্র্যাকিথেরাপি দেওয়ার একমাত্র মেশিনটি এবং রেডিয়েশন থেরাপির দুটি কোবাল্ট-৬০ মেশিন বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া ক্যানসার রোগীদের পর্যাপ্ত সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতালটি।
অন্যদিকে সীমিত পরিসরে সেবা দেওয়া সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোও সচল যন্ত্রপাতির অভাবে ভুগছে। নয়টি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঁচটিতেই রেডিওথেরাপি মেশিন ঠিকভাবে কাজ করে না।
এছাড়া এসব হাসপাতালের সবগুলোতে কেমোথেরাপি দেওয়া হয় না এবং এগুলোর ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা নিয়েও রয়েছে রোগীদের অসন্তুষ্টি।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটি-এর সভাপতি ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সরকারি হাসপাতালে মেশিন নষ্ট থাকা ও অপর্যাপ্ত ডায়াগনোসিস সুবিধার কারণে অনেক রোগী বিদেশে চলে যান।
'আমার মনে হয়, দেশে বেসরকারি পর্যায়ে উন্নতমানের ডায়াগনোসিস সেবা ও চিকিৎসা দেওয়া গেলে ক্যানসার চিকিৎসায় রোগীদের বিদেশ যাওয়ার হার কমবে,' বলেন তিনি।
বার্ষিক চিকিৎসা খরচ
প্রতি বছর চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান প্রায় সাত লাখ বাংলাদেশি। ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য বছরে কতজন রোগী বিদেশে যান, তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীদের বেশিরভাগই ক্যানসারের রোগী।
মেডিক্যাল ট্যুরিজম গন্তব্যের তালিকায় শীর্ষস্থানে রয়েছে ভারত। এরপরে আছে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ অর্থবছরে বিদেশে চিকিৎসার জন্য ২.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছেন বাংলাদেশিরা। ২০২০ এবং ২০২১ উভয় অর্থবছরে এ ব্যয় ছিল ১.৬ মিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ অর্থবছরে ২.৩ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছেন তারা। চলতি ২০২৩ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বিদেশে চিকিৎসা নিতে বাংলাদেশিরা ব্যয় করেছেন ১.১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।