সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় স্বস্তির ঈদযাত্রা
কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে কঠোর নজরদারি, হাইওয়ে পুলিশের তৎপরতা, ধীরগতির প্রকল্প এলাকায় বিশেষ উদ্যোগ, রেলওয়ের টিকেটে শতভাগ অনলাইন সিস্টেম চালুর সুবাদে এবারের ঈদযাত্রা ছিল স্বস্তির।
ঈদে যাত্রীর পরিমাণ তুলনামূলক কম হওয়ার পাশাপাশি পদ্মা সেতুসহ সব মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলতে দেয়ায় ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যও অন্যান্য বছরের চেয়ে কম হয়েছে বলে মনে করছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো।
সড়ক ও রেলের ব্যবস্থাপনায় স্বস্তির ঈদ উদযাপন শেষে গতকাল থেকে অনেকেই ফেরা শুরু করলেও রাজধানীর সড়কগুলো এখনও চিরাচরিত চেহারা ফিরে পায়নি। ঈদের পরের প্রথম কর্মদিবস সোমবারও বাস টার্মিনাল ও রেলস্টেশন এলাকা ব্যতীত রাজধানীর অধিকাংশ সড়কই ফাঁকা দেখা গেছে।
বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এবার মানুষ একটা ঝামেলামুক্ত ঈদযাত্রা করেছে বলে দাবি করেছেন সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সচিবালয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় সোমবার তিনি বলেছেন, 'এবার ঈদযাত্রা ছিল স্বস্তিদায়ক। ঘরমুখী যাত্রীদের জন্য এর চেয়ে ভোগান্তিহীন যাত্রা অনেক বছর ধরে হয়নি।'
সূত্র জানায়, ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, বিআরটিএ, পুলিশ সদর দপ্তরের পাশাপাশি সংস্থাটির বিভিন্ন ইউনিট, ডিটিসিএ ছাড়াও সড়ক পরিবহন মালিক, শ্রমিক ও যাত্রীদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত সভায় ঈদযাত্রায় স্বস্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়। একইসঙ্গে গাজীপুরমুখী যাত্রা সহজ করতে এক দশকের বেশি সময় ধরে চলতে থাকা বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্পের কিছু এলাকায় কাজ বন্ধ রাখার পাশাপাশি একটি এলিভেটেড সড়ক খুলে দেয়া, ড্রেন পরিষ্কার করা, বাড়তি লেন খুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়।
পরিকল্পনাগুলোর শতভাগ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আন্তরিকতার সঙ্গে উদ্যোগ নেয়ার কারণে ঈদযাত্রা স্বস্তির হয়েছে বলে মনে করেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. শামসুল হক।
তিনি বলেন, "এক্সটেনসিভ প্রেসার ম্যানেজমেন্টের কিউমিলেটিভ এফোর্টের পরিমাণ প্রতিবছরই বাড়ছে। প্রথম দিকে এমন বড় ইভেন্টে সমন্বয়ের অভাব ছিল। এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবার সফলতা পাওয়া গেছে।"
তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলে যাওয়ার পথে চন্দ্রা, এলেঙ্গা, কড্ডা, হাটিকামরুলসহ বিভিন্ন এলাকায় বড় ধরনের যানজট দেখা যেত। এবার এই সড়কগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ঈদের আগেই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বা সংস্কার কাজ শেষ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু ও সেতুকে কেন্দ্র করে এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা থেকে এলেঙ্গা হয়ে রংপুর পর্যন্ত সড়কে দ্রুতগতিতে যানবাহন চলতে পারায় কম পরিমাণের যানবাহনে বেশি মানুষ যাত্রা করতে পেরেছেন বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঈদযাত্রা তদারকি করতে বিআরটি'র সদর দপ্তরে স্থাপন করা একটি কন্ট্রোল রুম থেকে সারা দেশে মহাসড়কের যানজটপ্রবণ ৩৪টি এলাকা ক্যামেরার মাধ্যমে প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা নজরদারি করা হয়েছে। কোনো জায়গায় যানজটের লক্ষণ দেখা গেলেই হাইওয়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে সমাধানের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
১৭ এপ্রিল শুরু হওয়া ঈদযাত্রায় সারাদেশের কোথাও বাড়তি যানজটের তথ্য পাওয়া যায়নি। পরের দুই দিন সড়কে বাড়তি চাপে যানবাহন ধীরে চলেছে। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু সেতু এবং মেঘনা-গোমতী সেতুর টোলপ্লাজার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু সেতুর টোল প্লাজায়ও কিছুটা যানজট দেখা গেছে।
ঈদের আগের দিন সাভার, কালিয়াকৈর, চন্দ্রা ও গাজীপুরের কিছু পয়েন্টে যানজটের তথ্য পাওয়া গেছে। তবে তাৎক্ষণিক উদ্যোগের কারণে তা স্থায়ী হয়নি।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের কন্ট্রোলরুমে বিআরটিএ'র ফোকাল পয়েন্টের দায়িত্ব পালন করা সংস্থাটির পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, জটের কারণে লম্বা সময় ধরে কোথাও যানবাহন আটকে না থাকায় এবার ঈদযাত্রা স্বস্তির হয়েছে। আগেরবার বিভিন্ন টোল প্লাজায় ভিড় থাকলেও এবার এমনটা দেখা যায়নি। তাছাড়া বিআরটি প্রকল্পের ওভারপাস খুলে দেয়ার কারণেও ভোগান্তি কম হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব কুমিল্লা থেকে হাটিকামরুল পর্যন্ত সশরীরে দেখা করে সবাইকে আন্তরিকতার সাথে কাজ করতে বলেছেন। মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট সবাই মাঠে থেকে কাজ করেছেন। এর সুফলও পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, লম্বা ছুটি, মোটরসাইকেলের অবাধ যাত্রা, প্রত্যাশ্যার চাইতে কম মানুষের ঢাকা ত্যাগ করা ও ব্যবস্থাপনায় উন্নতির কারণে এবার মানুষ স্বস্তিতে ঈদযাত্রা করেছে।
মোটর সাইকেলের কারণে এবার বাসে চাহিদা কম থাকায় ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যও কম হয়েছে। ব্যবস্থাপনা ভালো থাকার কারণে এবার দুর্ঘটনাও ঘটেছে কম।
ট্রেনে ভোগান্তি কমিয়েছে অনলাইন টিকেট
১৭ তারিখ সকালে শুরু হওয়া ট্রেনের ঈদযাত্রা ছিল একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট। ৭ এপ্রিল অনলাইনে টিকিট কিনতে পারা যাত্রীরাই এদিন ট্রেনে চরতে পেরেছেন। তবে এর আগেরদিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী সোনার বাংলা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার শিকার হওয়ায় এদিন ট্রেনটির যাত্রা বাতিল করে পরের দিন দুইটি সোনার বাংলা চালানো হয়। তাছাড়া এই দুর্ঘটনার রেশ ধরে পরের দুই দিন পূর্বাঞ্চলীয় ট্রেনগুলোর শিডিউলে কিছুটা বিপর্যয় দেখা দেয়।
রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী তথা পশ্চিমাঞ্চলের ট্রেনগুলো বরাবরের মতই কিছুটা বিলম্বে ঢাকা ছাড়লেও শিডিউল বিপর্যয় হয়নি।
তবে ২০ এপ্রিল স্ট্যান্ডিং টিকেটের জন্য কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেল স্টেশনে যাত্রীদের বাড়তি চাপ দেখা যায়। কমলাপুর রেল স্টেশনে নিরাপত্তা ব্যারিকেড পার হয়ে বিনা টিকেটের যাত্রীরা ট্রেনের ভেতরে ও ছাদে চেপে বসলে টিকেটধারীদের যাত্রা বাধাগ্রস্ত হয়।
ঈদের দিনে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় ঝরেছে ২১ প্রাণ
ঈদের দিনে এবার সারা দেশের সড়কে ২২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে বিআরটিএ'র পক্ষ থেকে জানানো। সংস্থাটি বলেছে, এর মধ্যে মোটরসাইকেলের ২১টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ২১ জন।
বিআরটিএ'র পরিচালক শীতাংশু শেখর বিশ্বাস বলেন, "দুর্ঘটনায় যারা মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই তরুণ। মোটরসাইকেল এমনিতেই ইমব্যালান্সড যানবাহন। এরই মধ্যে চালিয়েছে ওভারস্পিডে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের বারবার বলা হলেও তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন।"
শৃঙ্খলার ঘাটতিই বড় চ্যালেঞ্জ: ওবায়দুল কাদের
সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সচিবালয়ে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের সময় সাংবাদিকদের বলেন, গাজীপুর রুটে বিআরটি প্রজেক্ট নিয়ে শঙ্কা ছিল। কিন্তু সেখানেও মানুষ নির্বিঘ্নে যাতায়াত করতে পেরেছেন। ঘরমুখী যাত্রার মতই ফিরে আসাটাও যেন স্বস্তিদায়ক হয় সে বিষয়ে কাজ করতে তিনি সবাইকে আহ্বান জানান।
এ সময় মন্ত্রী বলেন, ঈদের আগে সড়ক দুর্ঘটনা কম হলেও পরের যাত্রায় দুর্ঘটনা অনেক বেড়ে যায়। এ সময় একটু কঠোরভাবে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে হবে।
এ সময় তার মন্ত্রণালয়ের অধীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, নিরাপদ সড়ক করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। নিরাপদ সড়কের জন্য একনেক থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পাস হয়েছে।
ওবায়দুল কাদের বলেন, "আমাদের আসলে রাস্তা, ফ্লাইওভার, ফোর লেন, সিক্স লেন, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল- সবকিছু হচ্ছে এরপরেও আমরা পুরোপুরি স্বস্তিবোধ করতে পারছিলাম না একটা কারণে। সেটা হচ্ছে শৃঙ্খলার অভাব। পরিবহন এবং সড়কে শৃঙ্খলার ঘাটতি। সে শৃঙ্খলার ঘাটতিই আমাদের চ্যালেঞ্জ।"
পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল করতে দেওয়ার প্রসঙ্গ টেনে সেতুমন্ত্রী বলেন, "তরুণেরা ও মোটরসাইকেল চালকেরা যে শৃঙ্খলার সঙ্গে চালিয়েছেন, তা অসাধারণ।"
সাত দিনে পদ্মা সেতুর টোল আদায় ২০.৭৬ কোটি টাকার বেশি
১৭ থেকে ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে যানবাহনের টোল বাবদ ২০.৭৬ কোটি আদায় হয়েছে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ।
বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ সময়ে মোট ১.৮৮ লাখের বেশি যানবাহন সেতুটি পার হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকার দিক থেকে মাওয়া টোল প্লাজা হয়ে সেতু পার করেছে ১.১১ লাখ যানবাহন। আর জাজিরা টোল প্লাজা থেকে সেতু পার হয়ে ঢাকার দিকে এসেছে ৭৭.৩৪ হাজার যানবাহন।
২৩ এপ্রিল ঈদের পরের দিন ৩৬.৫২ হাজার যানবাহন সেতুটি পার হয়েছে। এই সংখ্যাটি পদ্মা সেতু জনসাধারণের জন্য খুলে দেয়ার তারিখ গত বছরের ২৬ মার্চ পারাপার করা ৫১.৩২ হাজার যানবাহনের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
এবারের ঈদের আগের দিন দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩.৯২ কোটি টাকার টোল আদায় হয়েছে পদ্মা সেতুতে। এর আগে গত বছরের ৮ জুলাই ঈদুল আজহার ছুটিতে এক দিনে ৪.১৯ কোটি টাকার টোল আদায় হয়েছিল সেতুটিতে।