গৃহপালিত পশুর চুরি ঠেকাতে জেগে ছিলেন তারা
রাত তখন দেড়টা। ৮৫ বছর বয়সী কবির আহমেদ তাসবিহ গুনছিলেন। নিজের চারটি ছাগল নিয়ে বসে ছিলেন আশ্রয়কেন্দ্রে। তিনি তাসবিহ গুনছিলেন মূলত ঘুম তাড়ানোর জন্য। কারণ ঘুমালেই ছাগলগুলো চুরি হয়ে যেতে পারে!
শুধু কবির নন, তার মতো শতাধিক মানুষ কক্সবাজার শহরের পৌরসভা এলাকার প্রিপারেটরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে রাত জেগে নিজেদের গবাদিপশু পাহারা দিচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রটিতে আসেন গবাদিপশু রাখার সুবিধার জন্যই।
কক্সবাজার শহরের নাজিরটেক এলাকার কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দা কবির আহমেদ একা আশ্রয় নিয়েছেন এই কেন্দ্রে। তার স্ত্রী, পুত্রবধু ও নাতি শহরের ৬ নম্বর ঘাট এলাকার সরকারি মহিলা কলেজকেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
শনিবার (১৪ মে) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে কবির দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "পরিবারের সদস্যদের মহিলা কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে এসেছি। সেখানে ছাগল রাখার সুবিধা নেই। তাই আমি একাই এখানে চলে এসেছি। বাসায় যেন চুরি না হয়, সেজন্য ছেলেকে বাসায় রেখে এসেছি।"
প্রিপারেটরি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রের তিনটি ভবনে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েকশ মানুষ। তাদের বেশিরভাগ শহরের নাজিরটেক এলাকার বাসিন্দা। বৃদ্ধ, নারী, শিশু থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। যাদের গবাদিপশু আছে, তারা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছিলেন। শিশু, নারীরা ক্লান্তি নিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলেন। তবে মশার কামড়ে একটু পর পর উঠে বসতে দেখা যায় শিশুদের।
নাজিরটেকের বাসিন্দা রাশেদা বেগম ও তার মেয়ে নিশাত মুন্নি ছয়টি ছাগল নিয়ে এসেছেন এখানে। বিদ্যালয়ের নতুন ভবনের পাশের একটু পুরাতন ভবনের নিচতলায় আশ্রয় নিয়েছেন তারা। রাশেদা টিবিএসকে বলেন, "এখানে শনিবার দুপুর ১২টায় এসেছি আমরা। জুতা রেখে ছাগলের জন্য খাবার বানাতে গিয়েছিলাম। এসে দেখি চুরি হয়ে গেছে। এজন্য আর ঘুমাবো না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।"
কুতুবদিয়া পাড়ার বাসিন্দা ফরিদুল আলমের স্ত্রী, চার ছেলে ও এক মেয়েসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে খুরস্কুল আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে এসেছেন। ওই কেন্দ্রেও গরু রাখার জায়গা নেই। তাই পরিবারের সদস্যদের রেখে তিনি একা অবস্থান নিয়েছেন এই কেন্দ্রে। ফরিদুলের ভাষ্য- "এই ৫টি গরুই আমার শেষ সম্বল। তাই এগুলো বাঁচাতে এখানে এসেছি।"
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ গতকাল বলেন, "সন্ধ্যা ৭টায় কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৭০৩ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। লোকজন আরও আসছে, এই সংখ্যা আরও বাড়বে।"
তিনি আরো বলেন, "মোখা মোকাবিলায় সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। অধিক ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে আনা শুরু হয়েছে। ১০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ও পর্যাপ্ত গাড়ি মজুদ রয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে অনেককে মহেশখালী নিয়ে আসা হয়েছে। জেলায় পর্যাপ্ত খাদ্য ও টাকার মজুদ রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে।"
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. কামরুজ্জামান জানান, টেকনাফের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রচুর মানুষ আসছেন। প্রায় ২০ হাজার মানুষ এসেছেন। সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ৭ হাজার মানুষ আছেন। সেখানকার শতভাগ মানুষকে নিরাপদে রাখা হয়েছে। হোটেল মোটেলগুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। সেন্টমার্টিনের ১০ শয্যার হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এছাড়া টেকনাফে ৬টি মেডিকেল টিম ও একটি ভ্রাম্যমাণ মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
রোববার (১৪ মে) সকাল ৯টা থেকে বেলা ৩টার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় মোখা কক্সবাজার ও উত্তর মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। এটি এখন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। কক্সবাজার সমুদ্রবন্দর থেকে ঘূর্ণিঝড়ের দূরত্ব ৪১০ কিলোমিটার।