কারওয়ান বাজারকে যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজারে স্থানান্তরের পরিকল্পনা উত্তর সিটির, রাজি না ব্যবসায়ীরা
রাজধানীর কারওয়ানবাজার স্থানান্তর করে যাত্রাবাড়ী ও আমিনবাজারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও তাতে রাজি হচ্ছে না কারওয়ানবাজারের ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের দাবি, তাদের ব্যববসা করার জন্য প্রয়োজনে কারওয়ান বাজারকেই পুনর্গঠন করা হোক, কিন্তু তারা এখান থেকে সরতে রাজি নয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, কারওয়ান বাজারে কোন কাঁচাবাজার থাকবে না। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী একটি স্মার্ট সিটি গড়ে তুলতে রাজধানীর কেন্দ্রে এভাবে একটি পাইকারি কাঁচাবাজার থাকতে পারে না। এছাড়া কারওয়ান বাজারের মার্কেট ভবনগুলো পরিত্যক্ত হওয়ায় সবার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরীর লক্ষ্যে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়েছে উত্তর সিটির পক্ষ থেকে। স্থানীয় তিনজন কাউন্সিলর, কারওয়ান বাজারের সুপার মার্কেট ও কাঁচাবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও ডিএনসিসির কর্মকর্তার সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হবে। যারা কমিটি গঠনের পরে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিবে।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর টিসিবি ভবনে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের লক্ষ্যে কারওয়ান বাজারস্থ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময় সভা করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ সভায় অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম।
সভায় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা তাদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন। তারা জানান, কারওয়ান বাজারের সাথে সারা দেশের অন্তত ৪ কোটি লোক সম্পৃক্ত। কারওয়ান বাজারের আড়তদাররা কৃষকদের সার, কীটনাশক কিনে দেয় এবং সেই মালামাল ঢাকায় এনে ২ কোটি মানুষের জোগান দেয়।
তারা আরও বলেন, যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজারে যে মার্কেট করা হয়েছে সেখানে ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নেই। তারা যেন কারওয়ান বাজারেই থাকতে পারেন সেই ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন ব্যবসায়ীরা।
সভায় মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, 'পৃথিবীর কোন উন্নত দেশের রাজধানীর মাঝখানে এমন পচনশীল পণ্যের পাইকারি কাঁচাবাজার নেই। স্মার্ট বাংলাদেশে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে পাইকারি কাঁচাবাজার থাকতে পারে না। কারওয়ান বাজারে কোন কাঁচাবাজার থাকবে না। উন্নত দেশের পাইকারি মার্কেটগুলো পরিদর্শন করেছি। পর্যাপ্ত খালি জায়গাসহ সকল সুবিধা নিশ্চিত করে মার্কেটের নকশা করা হবে।'
সবার সাথে আলোচনা করেই কারওয়ান বাজার মার্কেটটি স্থানান্তর করা হবে উল্লেখ করে মেয়র বলেন, 'এগারো সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করে দিচ্ছি। স্থানীয় তিনজন কাউন্সিলর, কারওয়ান বাজারের সুপার মার্কেট ও কাঁচাবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ী মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ ও ডিএনসিসি কর্মকর্তার সমন্বয়ে এই কমিটি গঠিত হবে। পনেরো দিনের মধ্যে কারওয়ান বাজার স্থানান্তরের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন জমা দিবে।'
মেয়র বলেন, 'মার্কেট স্থানান্তর হলে নতুন মার্কেটে সমপরিমাণ জায়গা বরাদ্দ দেয়া হবে। এর জন্য নতুন করে কোন টাকা দিতে হবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এমন সিদ্বান্ত আমাদের জানিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি কথা দিচ্ছি ক্রেতা-বিক্রেতাদের জন্য কারওয়ান বাজারের চেয়ে বহুগুণ সুবিধা সম্বলিত নিরাপদ আধুনিক মার্কেট নির্মাণ করে দেয়া হবে।'
মেয়র আরও বলেন, 'সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে কারওয়ান বাজার সরানোর জন্য যাত্রাবাড়ী, গাবতলী ও মহাখালীতে মার্কেট নির্মাণ করা হয়। এটি একনেকে পাশ হওয়া প্রকল্পের আলোকে হয়েছে। সেই সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনেই একনেকে পাশ হয়ে এটি বাস্তবায়ন করা হয়। অতএব, এটি কারো মনগড়া কথা নয়।'
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, 'কাউকে জোর করে, ব্যবসা বন্ধ করে, রুটি-রোজগার বন্ধ করে আমরা কারওয়ান বাজার স্থানান্তর করবো না। আপনাদের (ব্যবসায়ীদের) জন্য বিকল্প ভালো ব্যবস্থা করেই স্থানান্তর করা হবে। ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই সিদ্বান্ত নেয়া হবে।'
তিনি আরও বলেন, 'ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের বিকল্প ব্যবস্থা দ্রুতই করতে হবে। আমরা কেউই চাই না আত্মাহুতি দিতে। সবাই মিলেমিশে বিকল্প ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা আশা করি উইন-উইন পজিশন নিশ্চিত করে কারওয়ান বাজারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।'
স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মোঃ তাজুল ইসলাম বলেন, 'কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে ফুটপাতের ব্যবসায়ীরা কেউই পরিকল্পনার বাইরে নয়। কারওয়ান বাজারের পাইকারি মার্কেট স্থানান্তর একটি জটিল সমস্যা। সবার সহযোগিতায় এই সমস্যা সমাধান করতে হবে। পৃথিবীর সকল দেশের উন্নয়নে ডেস্ট্রাকশন কনস্ট্রাকশন হয়েছে। কাউকে রিজিড হওয়া যাবে না। কাউকে প্রতিপক্ষ হিসেবে চিন্তা না করে একপক্ষ হিসেবে চিন্তা করতে হবে।'
সরতে রাজি না ব্যবসায়ীরা
কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ৎ সমিতির কোষাধ্যক্ষ মোঃ মোশারফ হোসেন মণ্ডল বলেন, 'কারওয়ান বাজারের সাথে ৪ কোটি লোক সম্পৃক্ত। আমরা কৃষকদের সার, কীটনাশক কিনে দেই। সেই মালামাল ঢাকায় এনে ২ কোটি মানুষের জোগান দেয়। যাত্রাবাড়ী, আমিনবাজারে যে মার্কেট করা হয়েছে সেখানে আমাদের সুযোগ নেই। এ মার্কেটগুলো আপনাদের গলার কাঁটা, এখন আমাদের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চান। আমরা যেন কারওয়ান বাজার থাকতে পারি সেই ব্যবস্থা করুন।'
কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচা মাল আড়ৎ সমবায় সমিতির সভাপতি হাজী মোঃ আবুল বাশার বলেন, 'আমি ১৯৭৩ সালে কারওয়ান বাজারে এসেছি। আমরা ডোবা ভর্তি করে মার্কেট করেছি। এখানে যে মার্কেটগুলো করা হয়েছে সেখানে দুর্নীতি হয়েছে। তা না হলে কি ভবন করেছেন যে মানুষ ৪০ বছরেও ব্যবহার করতে পারে নাই? আমরা কারওয়ান বাজারে থাকতে চাই। আমাদের ব্যবস্থা না করে এখান থেকে না সরানোর অনুরোধ করছি।'
কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ৎ সমিতির সভাপতি মোঃ ওমর ফারুক বলেন, 'এ মার্কেট ছিল অবৈধ দখলদারদের হাতে। এ পর্যন্ত সিটি কর্পোরেশন ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকা আমাদের থেকে নিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে কিছুই দেয়নি। গাবতলীতে মার্কেটগুলো ভাসানচরের মতো। সেখানে কেউ কেনাকাটা করতে যাবে না।'
কারওয়ান বাজার কাঁচামাল আড়ৎ ব্যবসায়ী মালিক বহুমুখী সমবায় সমিতির (পাকা আড়ৎ ভবন) সাধারণ সম্পাদক মোঃ সাইফুর রহমান চৌধুরী বলেন, 'আমাদের কারওয়ান বাজারেই ব্যবস্থা করে দিন। যাত্রাবাড়ী, গাবতলীর অবস্থা আরও খারাপ। কারওয়ানবাজারে নতুন করে পরিকল্পনা নিয়েই এখানে আমাদের ব্যবস্থা করুন।'